১৯৪৭ সালের শেষের দিকেই মহাকাশ পৌঁছানোর কৌশল রপ্ত করে ফেলছিল যুক্তরাষ্ট্র। পিছিয়ে ছিল না রাশিয়াও। কিন্তু মহাকাশ কি আদৌ নিরাপদ মানুষের পক্ষে? সেখানে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ নেই, নেই মাধ্যাকর্ষণ টান, অক্সিজেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের তেজস্ক্রিয় মহাজাগতিক রশ্মি ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাকাশে। মানবদেহে কী-ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে সেগুলি? এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই মাছি থেকে শুরু করে ইদুর, বিড়াল, বানর, কুকুর-সহ বিভিন্ন প্রজাতির শতাধিক প্রাণী মহাকাশে পাঠিয়েছে মানুষ। মহাকাশ-যাপন তাদের শরীরে কী কী প্রতিক্রিয়া ফেলে, তা পর্যবেক্ষণ করে সমস্যার সমাধানও খুঁজে বার করেছে মানুষ। কিন্তু মহাকাশ গবেষণার প্রাথমিকস্তরের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার তালিকা থেকে বাদ রয়ে গিয়েছিল উদ্ভিদ।
দীর্ঘদিন যদি কোনো উদ্ভিদের বীজ রেখে দেওয়া হয় মহাকাশে? কী কী পরিবর্তন হয় তার মধ্যে? সেই বীজ থেকে জন্মানো উদ্ভিদ কী আদৌ স্বাভাবিক হয়? মহাকাশ জয়ের কয়েক যুগ পরে ২০০৮ সালে এই প্রশ্ন জেগেছিল মানুষের মনে। নেপথ্যে জাপানের (Japan) মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘জাক্সা’ (JAXA)।
দেখতে গেলে, ‘নাসা’ এবং রুশ মহাকাশ সংস্থা ‘রসকসমস’-এর থেকে বয়সে অনেকটাই তরুণ জাপানের এই সংস্থা। ‘জাক্সা’-র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ২০০৩ সালে। তার ঠিক পাঁচ বছরের মধ্যেই মহাকাশে উদ্ভিদের বীজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন জাপানের মহাকাশ গবেষকরা। অবশ্য মহাকাশে সেই বীজ কৃত্রিমভাবে স্থাপন করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাঁদের। বরং, এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল, মহাকাশ-ফেরতা উদ্ভিদের বীজ পৃথিবীতে ফিরে এনে তা রোপণ করা।
যেমন পরিকল্পনা তেমনই কাজ। জাপানের একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ ‘গিফুর গাঞ্জোজি’-র প্রাঙ্গন থেকে সংগ্রহ করা হয় ১২৫০ বছর বয়সি প্রাচীন চেরির গাছের (Cherry Tree) বেশ কিছু বীজ। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে পাড়ি দেওয়ার সময় এই বীজগুলি সঙ্গে নিয়ে যান জাপানের এক নভোচারী। সবমিলিয়ে প্রায় ৮ মাস মহাকাশে ছিলেন তিনি। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন ৪১০০ বার। ২০০৯ সালে পৃথিবীতে ফিরে আসেন তিনি। তারপর, জাপানের সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ মোনাস্টারিতেই রোপণ করা হয় একটি বীজ। বাকিগুলিকে সংরক্ষিত করা হয় ভবিষ্যতে গবেষণার জন্য।
এই গল্প আপাতত এখানেই থামিয়ে রাখা যাক। এবার, কাট টু ২০১৪। কোনো গবেষক নন, সর্বপ্রথম কয়েকজন বৌদ্ধভিক্ষুর নজরে পড়েছিল বিষয়টা। এপ্রিল মাসের পয়লা তারিখ পড়তে না পড়তেই ফুল ধরেছে চেরি গাছে। সাধারণত চেরি ফুল ফোটে আরও পরে। এপ্রিলের শেষের দিক বা মে মাস নাগাদ। না-হয় মেনে নেওয়াই গেল, বদলে যাওয়া পরিবেশের কারণেই এই বদল হয়েছে গাছে। কিন্তু ফুলের এমন অদ্ভুত গঠনের কারণ কী? ৩০টির বদলে প্রতিটি ফুলে রয়েছে মাত্র ৫টি করে পাপড়ি!
কয়েকদিনের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় গোটা ব্যাপারটা। না, এটি কোনো সাধারণ চেরি গাছ নয়। বরং, মহাকাশ-ফেরতা চেরি বীজ থেকে জন্মানো বৃক্ষ। মজার বিষয় হল, শুধু ফুলের প্রকৃতিই নয়, গাছটির বৈশিষ্ট্যও রীতিমতো অবাক করে দিয়েছিল গবেষকদের। সাধারণত, চারা রোপণের ১০ বছর পর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে চেরি গাছ। ফুল ধরতে শুরু করে তারও পরে। অথচ, সংশ্লিষ্ট গাছটিতে ফুল ফোটা শুরু হয়েছিল মাত্র ৬ বছর বয়সেই। যেন কোনো মহাজাগতিক শক্তির ‘আশীর্বাদে’ প্রকৃতির সমস্ত নিয়মকে অগ্রাহ্য করেই বেড়ে উঠছে এই বৃক্ষ। কাজেই আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, মহাশূন্যের মাধ্যাকর্ষণহীনতা কিংবা মহাজাগতিক রশ্মি প্রাভবিত করেছিল এই বিশেষ চেরি বীজটিকে। অবশ্য বীজের মধ্যে ঠিক কী কী রাসায়নিক বা গঠনগত পরিবর্তন হয়েছিল মহাকাশ-যাপনের ফলে, খাতায়-কলমে তা প্রমাণিত হয়নি আজও। সবমিলিয়ে আজও অমীমাংসিত এই রহস্য।
এবার এগিয়ে আসা যাক আরও বছর কয়েক। ২০১৯ সালের কথা। চিন জানিয়েছিল, মহাকাশে আদৌ মানবশিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে কিনা, তা নিয়ে বিশেষ পরীক্ষা করবে তারা। সন্তানসম্ভবা মহিলাদের প্রাথমিকভাবে রাখা হবে কৃত্রিমভাবে তৈরি অভিকর্ষহীন একটি কক্ষে। এমনকি এই পরীক্ষা সফল হলে, ২০২৪ সালের মধ্যেই মহাকাশে পাঠানো হবে তাঁদের। মানবজাতি আগামীতে মহাশূন্যে বেঁচে থাকতে পারে কিনা— তা প্রমাণ করাই এই গবেষণার লক্ষ্য। তবে এই পরীক্ষা ঘিরে থেকে যায় একাধিক আশঙ্কা, মানবাধিকারের প্রসঙ্গও। বিশ্বের একদল গবেষক আজও মনে করেন মহাকাশে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান শূন্য হওয়ায় সেখানে জন্মানো মানবশিশুর আকার বিকৃত হতে পারে। দুর্বল হতে পারে হাড়। তাছাড়া তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রভাবে প্রাণসংশয়ও দেখা যেতে পারে তার। গবেষকদের এই অনুমান যে একেবারে মিথ্যে নয়, তার অন্যতম প্রমাণ জাপানের গিফুর গাঞ্জোজি মনেস্টারির আশ্চর্য চেরি গাছটি। অবশ্য এসব সতর্কতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছে চিন। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িতও হবে এই পরিকল্পনা। কিন্তু কী ফলাফল হবে তার? উত্তর দেবে সময়…
Powered by Froala Editor