সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নামটা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসংখ্য চরিত্র। অপু, ফেলুদা, উদয়ন পণ্ডিত… আর অবশ্যই নরসিংহ। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘অভিযান’ ছবিতে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের চরিত্রে দর্শককে মুগ্ধ করেছিলেন সৌমিত্র। তবে এই সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও অনেক গল্প। জড়িয়ে আছেন বাংলা সিনেমার আরেক কিংবদন্তি মানুষও। হয়তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জায়গায় আমরা ওই চরিত্রে দেখতে পেতাম উত্তমকুমারকেই।
সময়টা ৬০-এর দশকের একেবারে শুরু। প্রযোজক বিজয় চট্টোপাধ্যায় ঠিক করলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে ছবি তৈরি করবেন। পরিচালনা করবে ‘অভিযাত্রিক’ গোষ্ঠীই। গল্পের মুখ্য চরিত্রে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। কে করবেন অভিনয়? তখন বাংলা সিনেমায় নায়ক বলতে তো একজনই। বিজয় চট্টোপাধ্যায় ছুটে গেলেন উত্তমকুমারের কাছে। শুধু অভিনয়ের ক্ষেত্রে তাঁর একটাই অনুরোধ। নায়কসুলভ গ্ল্যামার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাস্, এই কথা শুনেই না করে দিলেন উত্তমকুমার।
উত্তমকুমারকে নায়ক হিসাবে পাওয়া গেল না। আরও নানা বিষয়ে বারবার বাধার মুখে পড়ছেন বিজয় চট্টোপাধ্যায়। বাধ্য হয়ে ছুটে গেলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। হাসিমুখে পরিচালনার ভার তুলে নিলেন তিনি। আর নরসিংহ? সেটা যেন তাঁর ভাবাই ছিল। এর আগে ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’-তে সৌমিত্রকে দিয়ে কাজ করিয়েছেন। এবারেও তাঁকেই বেছে নিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরে বলেছিলেন, “ভাগ্যিস উত্তমদা অভিনয়টা করতে রাজি হননি।”
উত্তম এবং সৌমিত্র বাঙালির কাছে ঠিক ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের মতো তর্জার বিষয়। অথচ দুজনের পারস্পরিক সম্পর্ক কিন্তু ঠিক তেমনটা ছিল না। এমনকি তাঁদের ক্ষেত্রও এতটাই আলাদা ছিল যে তুলনা করা প্রায় অসম্ভব। একদিকে উত্তমকুমার সবসময় ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন তাঁর নায়কসুলভ গ্ল্যামার। সৌমিত্র কিন্তু বারবার ছক ভেঙে এগিয়ে গিয়েছেন চরিত্র অভিনয়ের দিকে। তবে প্রভাব কি একেবারে পড়েনি?
আরও পড়ুন
‘সোনার কেল্লা’ নয়, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ই ছিল সৌমিত্রের প্রিয় ফেলু-সিনেমা
সৌমিত্রের থেকে অন্তত এক দশক আগে টলিউডে বাজিমাত করেছেন উত্তমকুমার। উত্তম-সুচিত্রা জুটি তখন বাঙালির হার্ট-থ্রব। সৌমিত্র তখন কলেজে পড়েন। অবশ্য জুটি উত্তম-সুচিত্রার হলেও সুচিত্রা সেনের রূপ লাবণ্যেই মুগ্ধ ছিলেন বেশিরভাগ যুবক। এই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করতেন সৌমিত্র। বলতেন, উত্তমকুমার একজন জাত অভিনেতা। সেই জাত অভিনেতার সঙ্গে আলাপ যদিও সিনেমায় নামার আগেই। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন উত্তমকুমার। সেই প্রথম আলাপ। এরপর ‘ঝিন্দের বন্দি’ থেকে সেটা প্রায় অন্তঃরঙ্গতায় পৌঁছে যায়। কখনো উত্তমকুমারের অভিনয় অনুসরন করেননি সৌমিত্র। কিন্তু প্রভাব তো পড়েছিলই। কীভাবে পজ নিতে হয়, কীভাবে অল্প হেসে মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে হয়; উত্তমকুমারের অভিনয় দেখেই সবই রপ্ত করেছেন সৌমিত্র।
এরপর ‘স্ত্রী’ সিনেমায় মুখোমুখি দুই অভিনেতা। দর্শক যেন একটা প্রতিযোগিতা দেখতেই এসেছেন। কিন্তু কোথায় কী? আবারও সেই জমিদারের গ্ল্যামারে ঢাকা উত্তমকুমার এবং সাধারণ একজন ফটোগ্রাফারের চরিত্রকে একটু একটু করে পর্দায় ফুটিয়ে তুলছেন সৌমিত্র। পরে অবশ্য উত্তমকুমারও নানা ধরনের চরিত্রাভিনয়ে মন দিয়েছিলেন। তাতে দক্ষতাও দেখিয়েছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও মনে করেন, চরিত্রাভিনয়ে মন দিলে উত্তমকুমার আরও বড় হতে পারতেন।
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায়কে ‘গুরু’ শিশির ভাদুড়ীর গল্প শোনাতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
তবে হয়তো উত্তমকুমার বুঝেছিলেন বাংলা সিনেমায় একজন নায়কের প্রয়োজন আছে, আর সৌমিত্র খুঁজেছিলেন শিল্পীকে। তাই আজও দুজনের মধ্যে কাউকেই এগিয়ে রাখা যায় না। এগিয়ে রাখার প্রয়োজনও নেই। উত্তম-সৌমিত্র এই নিয়েই তো তৈরি বাংলা সিনেমার একটি অধ্যায়। সব শেষ হয়ে গেলেও সেই ছবিগুলো থেকে যাবে।
তথ্যসূত্রঃ অগ্রপথিকেরা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
আরও পড়ুন
থেমে গেল সমস্ত লড়াই, প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor