শহরের পাকা রাস্তার উপর পাতা রেললাইন। তার উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে রেলগাড়ি। আর গাড়ির সামনে সামনে সাইকেল নিয়ে চলেছেন এক ব্যক্তি। না না, এ কোনো ‘খতরে কা খিলাড়ি’-র মতন খেলা নয়। আসলে সাইকেল আরোহীটি রেলেরই কর্মচারী। তাঁর কাজ রাস্তায় পথচারী দেখলেই সতর্ক করা। পিছনে রেলগাড়ি আসছে। এই ছিল কলকাতার উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দৃশ্য।
কলকাতা শহরের প্রথম পাকা রাস্তা সার্কুলার রোড। আর এই রাস্তার উপর দিয়েই ছুটে চলত রেলগাড়ি। না না, ছুটে চলত বলা ঠিক হবে না। বরং হেলতে দুলতে এগিয়ে চলত। অবশ্য নামটি ছিল ভারী গালভরা। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল রেলওয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, সৌজন্যে কলকাতা পুরসভা। থিয়েটার রোডের মোড় থেকে বাগবাজার পর্যন্ত চলত এই রেল। তবে যাত্রী ওঠানামার বালাই ছিল না। এই ট্রেনের কাজ ছিল শহরের যত ময়লা সংগ্রহ করা। আর তারপর রেলগাড়ি এগিয়ে চলত তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। ধাপার মাঠের দিকে। উনিশ শতক থেকেই শহরের সমস্ত ময়লা ধাপা মাঠে জমা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল।
১৮৬৩ সালে প্রথম কলকাতা মিউনিসিপ্যাল রেলওয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ১৮৬৮ সালের মধ্যে প্রথম দফার রেললাইন পাতার কাজ শেষ হয়ে যায়। প্রথমে এই রেলপথ ছিল মাত্র ৮ মাইল লম্বা। পরে ১৮৭৭ সালে রেলপথের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর কথা ভাবা হয়। পরের বছর তার দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ১২ মাইল। ১৯১০-১১ সালে আরও ৩ মাইল বাড়ানো হয় দৈর্ঘ্য। দেখতে দেখতে রেলপথ বাড়তে থাকে। কিন্তু তার গতি বাড়ে না। শহরবাসীর কাছেও এই ধীরগতির রেল ছিল বেশ কৌতুকের জিনিস। তাঁরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘ধাপা রেল’।
তবে ধাপা রেল কিন্তু শুধুই আবর্জনা বয়ে বেড়াত না। তার আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। সেই সময় শহরের নানা প্রান্তে চলছে রাস্তা তৈরির প্রক্রিয়া। রাস্তা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম কারখানা থেকে শহরে আসত নদী এবং খালপথে। নদীপথ এবং খালপথের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ বজায় রাখত এই ধাপা রেলই। রেলবোঝাই হয়ে যাবতীয় ইট, পাথর, লোহার পাইপ এসে পৌঁছত শহরের কেন্দ্রে। সেখানে ক্যাম্পবেল হাসপাতাল, অর্থাৎ আজকের নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের সামনের ফুটপাতে স্তূপাকারে জমা হত সমস্ত সরঞ্জাম।
আরও পড়ুন
উনিশ শতক, 'অশ্লীল' কলকাতা ও বাঙালির আদিরস-প্রীতি
মিউনিসিপ্যাল রেলওয়ের উন্নতির জন্য কলকাতা পুরসভার নিজস্ব একটি বোর্ডও ছিল। রেলের কাজ ঠিকমতো পরিচালনার জন্য রাখা হয়েছিল একজন সুপারিন্টেন্ডেন্টকে। রেলের চালক ছাড়াও ছিলেন ওয়ে ইন্সপেক্টর, আর এক সাইকেল চালক। এছাড়াও বোর্ডে ছিলেন বেশ কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার। ট্রেনের গতি বাড়ানো সহ নানা বিষয়ে আলোচনা চলত বোর্ডের মধ্যে। তবে কালের নিয়মে আজ সবই ইতিহাস।
আরও পড়ুন
এলগিন ফেয়ারলন এবং কলকাতা 'দ্য সিটি অব জয়'-এর গল্প
ধাপা মেল আজ আর নেই। নেই তার রেলপথটাও। কিন্তু ধাপার মাঠ থেকে গিয়েছে। আজ আর তাকে নিচু জলাভূমি বলে মনে হয় না। বরং পাহাড়ের মতো আবর্জনার স্তূপ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মাঠের সঙ্গেই যে এমন একটা রেললাইনের যোগাযোগ ছিল একসময়, সে খবরও আজ প্রায় বিস্মৃত।
তথ্যসূত্রঃ শিয়ালদহ-বৈঠকখানার কড়চা, বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা পুরশ্রী
কলকাতা পুরসভার ধাপা মেল, বর্তমান পত্রিকা
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ কলকাতায় নববর্ষ উদযাপন, সমুদ্র পেরিয়ে হাজির ইতালির গায়িকা!
Powered by Froala Editor