প্রথম বাঙালি যুদ্ধবিমান চালক তিনি, মৃত্যুর আগে ধ্বংস করেছিলেন শত্রুপক্ষের ৯টি বিমান

'অন্নপায়ী বঙ্গবাসী / স্তন্যপায়ী জীব' এই ধারণাকে ভাঙতে চেয়েছিলেন অনেকেই। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন, 'ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন'। বেদুইন না হোক, সে-যুগে বাঙালি সন্তান যুদ্ধবিমান চালিয়েছে, এও এক বড় কথা বৈকি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিশেষ সাফল্যের জন্য তখন যুদ্ধবিমানের চালকদের দেওয়া হত 'ফ্লাইং এস' সম্মান। সেই বিরল সম্মানের অধিকারীও যে ছিলেন একজন বাঙালি, আমরা সেকথা বিশেষ মনে রাখিনি।

যাঁর কথা হচ্ছে, তাঁর নাম ইন্দ্রলাল রায়। নামটা অনেকের কাছেই অচেনা ঠেকতে পারে। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম দুঃসাহসী মানুষদের তালিকা তৈরি করতে গেলেও তাঁর নাম এসে যায়। ১৮৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতাতেই জন্মেছিলেন ইন্দ্রলাল রায়। তাঁর বাবা সেযুগের বিখ্যাত ব্যারিস্টার প্যারীলাল রায়। আর মাতামহ সূর্য চক্রবর্তী ভারতের প্রথম অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। সমস্ত ধর্মীয় বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে 'কালাপানি' পেরিয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। বোঝাই যাচ্ছে, আর পাঁচটা বাঙালির মতো কাটেনি তাঁর শৈশব। ১৯০১ সালে পেশাগত কারণে লন্ডন চলে গেলেন প্যারীলাল। বছর দুয়েক পর পরিবারকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। মেজ ছেলে ইন্দ্রলাল ওরফে ল্যাডির বয়স তখন বছর পাঁচেক। দুই ভাইয়ের সাথে ইন্দ্রলাল ভর্তি হলেন সেন্ট পলস বয়েজ স্কুলে। পড়াশুনোতে মেধাবী ল্যাডি। তার সাথে চলছিল সাঁতার, বক্সিং, ঘোড়ায় চড়া।

এর মধ্যেই এসে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তখন ১৯১৪ সাল। দাদা পরেশ যোগ দিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। ইন্দ্রলালের বয়স তখন পনেরো। দাদাকে দেখেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে হয় তাঁর। সঙ্গে ছোটো থেকেই ছিল আকাশে ওড়ার ইচ্ছা। যোগ দিলেন স্কুলের ক্যাডেট কোর্সে। তারপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। কিন্তু মন তো পড়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রে। কলেজে পড়াকালীন ইংল্যান্ডের রয়্যাল এয়ার কর্পসে আবেদন করলেন। কিন্তু অস্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তির জন্য আবেদন মঞ্জুর হল না। তবে হাল ছাড়ার পাত্র নন ইন্দ্রলাল। শখের মোটরবাইক বিক্রি করে লন্ডনের সবচেয়ে নামী ডাক্তারের কাছে চোখের চিকিৎসা করালেন। তারপর অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হল। ১৯১৭ সালের ৫ জুলাই রয়্যাল এয়ার কর্পসে যোগ দিলেন ৫৬ নম্বর স্কোয়াড্রনের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে। ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাঙালি যুদ্ধবিমান চালক।

বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ করে আকাশে উড়লেন। এরপর আর তাঁকে আটকায় কে? শত্রুপক্ষের একের পর এক বিমান গুলি করে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন ল্যাডি। ল্যাডি তখন ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর 'হিরো'। একটার পর একটা দুঃসাহসী অভিযানের দায়িত্ব নিচ্ছিলেন নিজের ইচ্ছেতে। এর মধ্যেই একদিন, ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর, জার্মান বাহিনীর আক্রমণে তাঁর বিমান ভেঙে পড়ল। 'নো ম্যানস ল্যান্ড' থেকে খুঁজে পাওয়া গেল তাঁর দেহ। ডাক্তার বললেন, মৃত। কিন্তু মর্গের দরজা বন্ধ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিতর থেকে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ। অনেকেই নাকি ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিলেন। আসলে ভূত নয়, ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন জলজ্যান্ত ইন্দ্রলাল। তিনি তখনও জীবিত।

ফিরে এসে আবার আকাশে উড়তে চাইলেন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার কারণেই কর্তৃপক্ষ আবেদন মঞ্জুর করলেন না। ইন্দ্রলাল কিন্তু বারবার আবেদন করে গেলেন।

১৯১৮ সালের ৬ জুলাই আবার আকাশে উড়লেন তিনি। ৯ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই, দশদিনে জার্মানির ৯টি যুদ্ধবিমান তিনি একাই আক্রমণ করে ধরাশায়ী করলেন। ২২ জুলাই, একইভাবে আকাশে উড়ছেন। লক্ষ্য জার্মানির বাহিনীর দিকে। এমন সময় জার্মানির চারটি বিমান একসঙ্গে তাঁকে ঘিরে ধরল। চারটি বিমানের সঙ্গে লড়াই করে গেলেন একাই। দুটিকে ধরাশায়ী করতেও পারলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। জার্মান বাহিনীর একটি গুলিতে তাঁর বিমানের ট্যাংকে আগুন ধরে গেল। জ্বলতে জ্বলতে সেটা আছড়ে পড়ল মাটিতে। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ইন্দ্রলালের শেষ অভিযান শেষ হয়ে গেল। মৃত্যুর পর পেয়েছিলেন 'ফ্লাইং ক্রস' সম্মান।

ফ্রান্সের এসতেভেলেস কমিউনাল সেমেটরিতে ইন্দ্রলালের সমাধির উপর লেখা, "মহাবীরের সমাধি। সম্ভ্রম দেখাও। স্পর্শ ক'রো না।" বাঙালি এই মহাবীরকে কতটুকুই বা মনে রেখেছে? শুধু ভবানীপুরের একটি রাস্তার নাম হয়ে থেকে গেছেন তিনি। তবে তাঁর সম্মান রেখেছিলেন ভাগ্নে সুব্রত মুখোপাধ্যায়। স্বাধীন ভারতের প্রথম এয়ার মার্শাল আসলে হয়তো তাঁর মামার স্মৃতিকেই সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র – রোর বাংলা

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More