১৯৬৯ সাল। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির শুটিং শুরু করেছেন সত্যজিৎ রায়। পরিচালক হিসেবে ততদিনে বাংলা তো বটেই, বিশ্বের দরবারেও পৌঁছে গেছেন তিনি। শুটিংয়ের দৌলতেই কলাকুশলীদের নিয়ে পৌঁছে গেছেন দার্জিলিং। কাজ তো মিটল; কিন্তু সেখানে আরও কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হল সত্যজিতের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুই বিশেষ অতিথি, বলা ভালো রাজকীয় অতিথি। সিকিমের তৎকালীন রাজা এবং রানি সত্যজিৎ রায়কে অনুরোধ করেন যাতে সিকিমের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করা যায়। তাঁর মতো একজন পরিচালক এই কাজটি করলে বিশ্বের দরবারে সিকিমের সৌন্দর্য আরও বেশি করে পৌঁছবে। ফলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিকিমের মান যেমন বাড়বে, তেমনই পর্যটনও বাড়বে। সবার থেকে স্বতন্ত্র হয়ে বেড়ে উঠবে দেশটি…
ওপরের লেখাটি সত্যজিৎ রায়ের ‘সিকিম’ তথ্যচিত্রটি নির্মাণের প্রেক্ষাপট হিসেবে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু গোটা লেখায় একটা বিশেষ জায়গায় কি আপনার চোখ আটকে গেছে? কোথাও কি খটকা লাগছে? একটু মন দিয়ে পড়লেই ব্যাপারটি নজরে আসবে। ‘স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিম’! এটা কেমন কথা? সিকিম তো ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্য। সুন্দর ভুপ্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য বরাবরই আকর্ষণের জায়গা হয়ে থেকেছে এটি। তাহলে আলাদা রাষ্ট্র বা দেশ কী করে হল? এখানেই লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত ইতিহাস। যার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে ভারত এবং সিকিমের সম্পর্ক। আজ যাকে অঙ্গরাজ্য হিসেবে দেখছেন, সেটিই একসময় ছিল স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। হ্যাঁ, সেই আদি অকৃত্রিম সিকিমের কথাই বলছি…
১৮১৪ সাল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ভারতের বুকে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে। স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত। তখনই ব্রিটিশদের সঙ্গে নেপালের যুদ্ধ শুরু হয়। সিকিম কাদের দখলে থাকবে, সেটাই ছিল মূল কেন্দ্রবিন্দু। উল্লেখ্য, সেই সময় নেপালি গোর্খারা সিকিম শাসন করত। ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধের পর সেই আধিপত্য কমে আসে; বদলে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশরাজ। তখনই অখণ্ড ভারতের এক আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। একটা সময় পর ব্রিটিশরা সিকিমের রাজপরিবারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিলেও নিজেদের রাশ শক্ত করে ধরে থাকে। সিকিমের স্বাধীনতাও একপ্রকার অস্তমিত তখন…
নানা ঘটনা, রক্ত ঝরার পর এল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। জাহাজে চেপে ব্রিটিশরা ফিরে গেল নিজেদের দেশে। ভারত এখন স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। তবে যাওয়ার আগে বেশ কিছু কাজ করে যায় ব্রিটিশরা। প্রথমত, বিশাল দেশটির মানচিত্রের ওপর দিয়ে চালানো হয় কাঁচি। রাতারাতি দুটো দেশে ভাগ হয়ে যায় ‘অখণ্ড’ ভারত। আর দ্বিতীয়ত, সমস্ত দেশীয় রাজ্যকে দুটি রাস্তার মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়। হয় ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হও, নয়তো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। বেশিরভাগ রাজ্যই প্রথম উপায়টি বেছে নেয়। ব্যাতিক্রম তিনটি রাজ্য; তাদের মধ্যেই অন্যতম হল সিকিম। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস শুধু ভারত আর পাকিস্তানের জন্ম দেখেনি; দেখেছে সিকিম নামক একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের আবির্ভাবও!
যে স্বাধীনতা একদিন ছিনিয়ে নিয়েছিল ইংরেজরা, তাঁরা যাওয়ার পর সেটাই ফিরে এল আবার। কিন্তু সময় তো একরকম থাকে না সবার। স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গার নেওয়ার পর হঠাৎই সিকিমের ভেতর আন্দোলন শুরু হয়। যার মূলে ছিল ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’ দল। তাদের বক্তব্য ছিল, সিকিমে রাজতন্ত্রের অবসান হোক এবার। নিজেরা ক্ষমতা ভোগ করবেন বলেই ভারত থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার দিকে ঝুঁকে ছিলেন রাজা। মূলত তাঁদেরই চাপে পড়ে কিছুটা মত বদলাতে বাধ্য হন সিকিমের তৎকালীন রাজা চোগিয়াল থাসি নামগয়াল। ১৯৫০ সালে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। যার সারমর্ম অনেকটা জম্মু ও কাশ্মীরের মতো। অর্থাৎ, সিকিম এখন থেকে ভারতের ‘আশ্রিত রাজ্য’। তাতে কী হল? সিকিমের ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’-এর তকমাটি পুরোপুরি উঠে গেল না। অভ্যন্তরীণ আইন কানুনে তাদের সম্পূর্ণ অধিকার রইল। ভারত কেবল সিকিমের পররাষ্ট্র, নিরাপত্তা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
সেই সময়ের যাবতীয় পরিসংখ্যান খুঁজলে দেখা যাবে, প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের থেকে সিকিম দেশটির উন্নয়নের ছবিটা তুলনামূলক ভালোই। বিশেষ করে শিক্ষা ও আয়ের ক্ষেত্রে এখানকার অবস্থা অত্যন্ত ভালো ছিল। চোগিয়াল থাসি’র ছেলে পালডেন থন্ডুপ নামগিয়াল সিংহাসনে বসার পর এই দিকটায় নজর দিয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্যই ছিল, সিকিমের উন্নয়ন ব্যবস্থা যেন গোটা এশিয়ায় নজির তৈরি করে। একটা মডেল হিসেবে উঠে আসে। ততদিনে উল্টোদিকে অন্য একটি স্রোত যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যার পতাকা বহন করছিলেন কাজী লেন্দুপ দর্জি। সিকিম স্টেট কংগ্রেসের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এই দলেরই সভাপতি ছিলেন তিনি। সিকিমের সিংহাসন থেকে রাজতন্ত্র সরাতে হবে, এটাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সেই কারণেই ১৯৬২ সালে তৈরি করেন ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’। দুই দেশের রাজনৈতিক চরিত্র বদলে যেতে থাকে। একদিকে চিনের ক্রমশ আগ্রাসন, অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে ইন্দিরা গান্ধীর আগমন— সবদিক থেকে নতুন ঘটনার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে ভারতীয় উপমহাদেশ। যার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সিকিম…
এমন সময়ই দেশে পর্যটন বাড়ানোর লক্ষ্যে সত্যজিৎ রায়কে তথ্যচিত্র বানানোর জন্য অনুরোধ করেন সিকিমের রাজা-রানি। সেইসূত্রেই ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় ‘সিকিম’ তথ্যচিত্র। সিকিমের প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ, অর্থনীতি সবকিছুকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন ক্যামেরায়। এমন সুন্দর পরিবেশের কোলেই তো বেড়ে উঠেছেন এই মানুষগুলো। তাঁরা তো একপ্রকার প্রকৃতিরই সন্তান! কিন্তু অদ্ভুতভাবে ছবিটির কোনো প্রদর্শনই হল না। সিকিমেও হয়নি, ভারতেও না। কারণ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সিকিমের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা দরকার। সিকিমের রাজা চেয়েছিলেন, দেশের পরিবেশ, ভুপ্রকৃতিই কেবল দেখানো হোক তথ্যচিত্রে। যাতে পর্যটন ক্ষেত্র আরও বেশি মজবুত হয়। কিন্তু সত্যজিৎ কাজ করেছিলেন নিজের মতো। সিকিমের সমস্তটাই তুলে ধরেছিলেন তিনি। তুলে ধরেছিলেন সেখানকার অধিবাসী নেপালিদের কথাও। সেটা রাজা ঠিক মানতে পারেননি। উল্টোদিকে, সিকিম যদি পর্যটন ক্ষেত্রে উন্নতি করে, তবে আর্থিক দিক থেকেও দেশটি স্বাবলম্বী হবে আরও। সেক্ষেত্রে ভারতের কর্তৃত্ব কমে যেতে পারে। উপরন্তু চিন শুরু থেকেই সিকিমের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় ছিল।
সব মিলিয়ে এই জটিল রাজনীতির আবর্তে পড়ে গেলেন সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর ‘সিকিম’। সেই সময় কোথাও তথ্যচিত্রটি মুক্তি পায়নি। পরবর্তীকালে অবশ্য রিল উদ্ধার হলে ২০১১ সালে প্রথমবার সিকিমে ছবিটি দেখানো হয়।
এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই নিজের স্বাধীন রাষ্ট্রের তকমা হারায় সিকিম। কাজী লেন্দুপ দর্জির নেতৃত্বে রাজা ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন শুরু হয় দেশে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে রাজা জয়ী হলেও কারচুপির অভিযোগে বাতিল করা হয় সেই ভোটগ্রহণ। ঠিক পরের বছর, ১৯৭৪ সালের নির্বাচনেই পরাজিত হয় সিকিমের রাজপরিবার। রাজা পালডেন থন্ডুপ নামগিয়াল বন্দি হন; আর প্রধানমন্ত্রীর জায়গায় আসেন কাজী লেন্দুপ দর্জি। ক্ষমতায় আসার পরই স্বাধীন রাষ্ট্রের তকমা থেকে বেরিয়ে আসতে চান তিনি। ভারতের এক অঙ্গরাজ্য হিসেবেই সিকিমকে দেখেছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত তাঁর ইচ্ছাই বাস্তব রূপ পেল। সিকিমকে রাজ্য হিসেবে বিবেচিত করার জন্য ভারতের সংবিধানও সংশোধন করা হয়। আলাদা একটি দেশ থেকে অন্য একটি দেশের অঙ্গরাজ্য— এটাই ছিল সত্তর দশকে সিকিমের পরিণতি। ১৯৭৫ সালের ১ মে— ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। সিকিমের স্বকীয়তা লোপ পায়, রাজতন্ত্রের অবসান হয়। ভারতের ২২তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয় সে…
তথ্যসূত্র-
১) ‘সত্যজিৎ রায়ের সিকিম একটি ঐতিহাসিক দলিল’, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, ‘যারা পরিযায়ী’ পত্রিকা
২) ‘সিকিমের স্বাধীনতা হারানোর উপাখ্যান’, মোনেম আহমেদ, রোর মিডিয়া
৩) উইকিপিডিয়া
Powered by Froala Editor