মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে চওড়া হাইওয়ে। আর তার দু’ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বাস, ট্রাক, জিপ, অ্যাম্বুলেস, ট্যাঙ্কার-সহ অজস্র গাড়ির মৃতদেহ। গোটা অঞ্চলজুড়ে যেন তাণ্ডব চালিয়ে গেছে কোনো মহাপ্রলয়।
ইরাক (Iraq) ও কুয়েতের মধ্যে অন্যতম সংযোগকারী পথ ‘হাইওয়ে ৮০’-তে গেলেই দেখা মিলবে এমন আশ্চর্য দৃশ্যের। অবশ্য লোকমুখে এই রাস্তা ‘হাইওয়ে অফ ডেথ’ বা ‘মৃত্যুর রাজপথ’ (Highway Of Death) নামেই পরিচিত। প্রায় দীর্ঘ দেড় কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে কমপক্ষে ২৭০০-র গাড়ির ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু ব্যাপার কী?
উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে ৩০ বছর। ১৯৯০ সাল। ২ আগস্ট। প্রতিবেশী রাষ্ট্র কুয়েত (Kuwait) আক্রমণ করেছিলেন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন। আর সেই সূত্র ধরেই সূচনা হয়েছিল রক্তক্ষয়ী ‘গালফ ওয়ার’-এর। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও, অল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম অধ্যায় হয়ে ওঠে এই দুই দেশের সংঘাত। জড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি।
কুয়েত-আক্রমণের পরই, সাদ্দাম হুসেনের এই পদক্ষেপকে শব্দবাণে বিঁধেছিল ২১ রাষ্ট্রের আরব লিগ। তবে তাতেও থামেননি তিনি। ফলস্বরূপ, নিরাপত্তার জন্য ৫ আগস্ট ন্যাটোর শরণাপন্ন হয় আরব লিগ এবং কুয়েত। অন্যদিকে এ-প্রস্তাবে সায় জানিয়ে কুয়েতকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এই কুয়েতের পাশে দাঁড়ায় ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির মতো একাধিক পশ্চিমি দেশ।
প্রাথমিকভাবে কেবলমাত্র যুদ্ধাস্ত্রের সরবরাহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল এই সাহায্যের পরিধি। তবে ১৯৯০-এর নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য সতর্কবার্তা পাঠানো হয় ইরাককে। সময় দেওয়া হয় জানুয়ারি পর্যন্ত। বলাই বাহুল্য এই প্রস্তাবে ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যায়নি ইরাকের থেকে। এর পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সেনা পাঠায় ন্যাটো। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি। শুরু হয় অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম। বলতে গেলে, ন্যাটোর এই অপারেশন কয়েক দিনের মধ্যেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল গোটা ইরাককে।
এক মাসের মধ্যেই সাদ্দাম হুসেন টের পেয়েছিলেন, কোয়ালিশন ফোর্সের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধজয় কার্যত অসম্ভব। আর তারপরই সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। দিনটা ছিল ১৯৯১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। যে ‘হাইওয়ে ৮০’-এর সুবাদে কুয়েতে পৌঁছেছিলেন ইরাকি সৈন্যরা, সেই রাস্তা ধরেই দেশের দিকে পাড়ি দেয় ৩০০০ গাড়ির বিশাল কনভয়। পণ্যবাহী ট্রাক, বাস, জিপ, ট্যাঙ্ক, অ্যাম্বুলেন্স তো ছিলই। সেইসঙ্গে বহু এই কনভয়ে আটকা পড়েছিল বহু সাধারণ মানুষের গাড়িও।
তবে অধিকাংশেরই ইরাকে ফেরা হয়নি আর। টানা দশ ঘণ্টা ধরে অবিরত এই রাস্তার ওপরে বোমাবর্ষণ করেছিল কোয়ালিশন ফোর্স। সেইসঙ্গে যুদ্ধবিমান থেকে গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় কনভয়ে আটকে পড়ে মানুষদের। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ন্যাটোর এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন দশ হাজারেরও বেশি মানুষ। যদিও এই তথ্যকে আজও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
তৎকালীন সময়ে গোটা বিশ্বজুড়েই চর্চিত হয়েছিল ন্যাটোর এই পদক্ষেপ। প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। ইরাকের সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরও কেন এহেন অমানবিক বোমাবর্ষণ করা হল, তা নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সমালোচনায় সামিল হয়েছিলেন তাঁরা। তবে মার্কিন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিচার্ড নিলের কথায়, ইরাকি সৈন্যদের দেশে ফেরা সাদ্দাম হুসেনের সেনা প্রত্যাহার ছিল না। বরং, বিপক্ষের চাপের সামনেই তিনি সেনা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন। কাজেই আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেনি তখনও। বলাই বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুক্তির পরও বিতর্ক থামেনি। থেকেই গেছে নৈতিকতা ও মানবিকতার প্রশ্ন। আর অন্যদিকে ‘হাইওয়ে ৮০’ হয়ে উঠেছে ‘হাইওয়ে অফ ডেথ’।
মজার বিষয় হল, এর বছর দশেক পর ফের ইরাকে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। অভিযোগ ছিল গণহত্যার জন্য বিশেষ যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কাজ করছে সাদ্দাম হুসেনের সরকার। আর যা গোটা বিশ্বের পক্ষেই বিপজ্জনক। সেই প্রকল্পে বাধা দিতেই ফের ইরাক হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথবাহিনী। সেবারেও এই মৃত্যুর রাজপথ দিয়েই ইরাকে প্রবেশ করেছিল সংযুক্ত বাহিনীর সৈন্যরা…
Powered by Froala Editor