লেদার অ্যাপ্রন নামক পাগল খুনিটার কথা কি আজও আমাদের মনে আছে? উনিশ শতকে যুক্তরাজ্যের প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল এই লেদার অ্যাপ্রন। ইস্ট এন্ড অফ লন্ডনের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল লেদার অ্যাপ্রনের মুক্তাঞ্চল। অঞ্চলটির নারী যৌনকর্মীরা ছিল তার মূল টার্গেট। সেই সময় লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল অঞ্চলে ছিল বেশ কিছু রেড লাইট এরিয়া। বলতে গেলে বেশ কিছুদিনের জন্য এইসব যৌনপল্লীতে এক প্রকার তালা ঝুলিয়ে দেয় লেদার অ্যাপ্রন নামক সেই খুনি যে তৎকালীন সময়ে অনেক বেশি পরিচিত ছিল জ্যাক দি রিপার নামে। যার তীক্ষ্ণ ছুরির আঘাতে খুন হয় একের পর এক যৌনকর্মী।
এতো গেল সুদূর যুক্তরাজ্যের কথা। কিন্তু এই বাংলা, আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে এই কলকাতা শহরের বুকেও ছিল এমনই এক নৃশংস সিরিয়াল কিলার। না স্টোনম্যান নয় - বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবে উঠে আসে এক বাঙালি মহিলার নাম। হ্যাঁ চমকে ওঠার মতোই ঘটনা বটে। সিরিয়াল কিলার তাও এক বাঙালি গৃহবধূ! কিন্তু কে এই বাঙালি মহিলা? কেমন ছিল তার জীবন?
বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। গ্রামের অধিবাসীরা বেশিরভাগই ব্যস্ত থাকেন চাষের কাজে। মহিলারা থাকেন তাদের প্রতিদিনের ঘরকন্নার কাজ নিয়ে। নিতান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন। আপাত দৃষ্টিতে বিশ্বের আর পাঁচটি গ্রামের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই গ্রামটির। এই গ্রামেই বসবাস করত ত্রৈলোক্যতারিণী। বাবা গ্রামের অন্যান্যদের মতোই সাধারণ ভাগচাষি। সংস্কারের আলো তখনও সেভাবে ছুঁতে পারেনি হিন্দু সমাজকে। স্বাভাবিকভাবেই সমাজে পুরোদমে চলছে বাল্যবিবাহ। গ্রাম্য অঞ্চলে এর প্রভাব আরও বেশি। ব্যতিক্রম নয় বর্ধমানের এই প্রত্যন্ত গ্রামটিও। সেই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে সমাজের প্রচলিত নিয়মেই গ্রামের অন্যান্য অনেক মেয়ের মতোই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে ত্রৈলোক্যতারিণীও। যদিও সেই বিয়ে ছিল নাম-কা-ওয়াস্তে। সতীনের জন্য কোনোদিন শ্বশুরবাড়ির মুখ দেখার সুযোগ হয়নি তারিণীর। ফলে সময়ের নিয়মে একসময় শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নিভে এল তার।
এরপর একদিন রাতের অন্ধকারে হঠাৎ করেই গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যায় তারিণী। এই ঘটনার মূল মাস্টারমাইন্ড ছিল তাঁর যুবক প্রেমিক। এরপরই তারিণীর ভোলবদল। বিয়ের পরেও প্রেমের সম্পর্ক, গ্রামে কানাকানির সূত্রপাত ঘটেছিল আগেই। এবার তারিণীর জন্য তার বাপের বাড়ির দরজাও চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল। তবে যুবকটি হয়তো প্রকৃত অর্থেই ভালোবেসেছিল তারিণীকে। কিন্তু তারিণী তার মর্যাদা দিতে ছিল অপারগ। পরবর্তীকালে তারিণীর হাতেই খুন হতে হয় যুবকটিকে। একপ্রকার বাধ্য হয়ে কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চলে ভাড়া থাকতে শুরু করে তারিণী। পেশা হিসেবে গ্রহণ করে পতিতাবৃত্তি। আর এই পতিতাবৃত্তির সূত্রেই তার পরিচয় ঘটল অপরাধ জগতের মাথাদের সঙ্গে - তারিণীরে পদার্পণ ঘটল অপরাধ জগতের বৃত্তে।
এরপর আসা যাক এক দারোগার প্রসঙ্গে। নাম তার প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। অবশ্য পুলিশের পাশাপাশি আরও বলেন একটি পরিচয় আছে তাঁর। তিনি ছিলেন সেই সময়ের একজন স্বনামধন্য লেখক। ১৮৭৮-১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন পুলিশ বিভাগে। তার প্রকাশিত বই 'দারোগার দপ্তর' থেকেই আরও বিস্তারিত জানা যায় বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার সম্পর্কে। তবে শুধুমাত্র 'দারোগার দপ্তরে'-ই সীমাবদ্ধ থাকেনি তারিণীর কুকীর্তি। পরবর্তীকালে দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের 'বাবু ও বারবনিতা' বইটিতে বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবে একাধিকবার উঠে এসেছে তারিণীর নাম।
সোনাগাছিতে থাকতে শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তারিণীর প্রথম প্রেমিকের। এই ঘটনায় সন্দেহের তীর যায় তারিণীর দিকেই। পুলিশও শুরু করল তদন্ত। কিছুদিনের মধ্যেই আটক করা হয় তারিণীকে। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় সে। সেই শুরু। তারপর দিন যত এগিয়েছে, ততই লম্বা হয়েছে খুনের লিস্ট। এরই মধ্যে একের পর এক পুরুষ এসেছে তারিণীর জীবনে। 'দারোগার দপ্তর' এবং পরবর্তীকালে 'বাবু ও বার-বনিতা' বই থেকেই জানা যায় সেইসব পুরুষ সঙ্গীদের সাহায্যেই ধনী বাড়ির মেয়েদের শিকারে পরিণত করত তারিণী। কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় পাঁচটি খুন করে ফেলে সে। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে উধাও হয়ে গেলেন পাঁচটি সমৃদ্ধশালী বাড়ির মহিলা।
এরপরেই টনক নড়ে পুলিশের। শুরু হল তদন্ত। তদন্তের শুরুতেই অদ্ভুত এক তথ্য উঠে এল পুলিশের হাতে। তারা জানতে পারল, পাঁচটি মৃত্যুর প্রত্যেকটি হয়েছে মানিকতলা এলাকায় এমনকি পাঁচটি মৃত্যুর প্রতিটির ধরন এক। প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে জলে ডুবে। কিছুদিনের চেষ্টায় পুলিশের জালে ধরা পড়ল তারিণী। পুলিশি তদন্ত শেষে উঠে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধুমাত্র গয়নার লোভে একের পর এক খুন করে গেছে ত্রৈলোক্যতারিণী। এই ব্যাপারে তার মূল ঘাঁটি ছিল মানিকতলা এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাগানবাড়ি। এখানেই বিভিন্ন ছলনায় তার শিকারদের ডেকে এনে গয়না লুঠ করে তারপর তাদের জলে ডুবিয়ে হত্যা করত তারিণী। আর সেই কাজটি করার সময়ই একজন দেখে ফেলে তাঁকে। তারিণীকে গ্রেপ্তারের পিছনে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। জেরার পর তারিণী স্বীকার করেছিল, পেট চালাবার জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে তাকে এই উপায় অবলম্বন করতে হয়। এর আগেও বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন চুরি এবং প্রেমিকের হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই প্রমাণ অথবা সাক্ষীর অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কিন্তু এবার পুলিশের হাতে ছিল অকাট্য প্রমাণ।
জ্যাক দি রিপারের ঘটনার প্রায় বছর আটেক আগেই কলকাতার বুকে ঘটে যায় এই নৃশংস সিরিয়াল কিলিং। যদিও কলকাতার অন্য এক সিরিয়াল কিলার স্টোনম্যানের মতো অমীমাংসিত থাকেনি তারিণী-রহস্য। তবে শুধুমাত্র গয়নার লোভের জন্য সিরিয়াল কিলিং হয়তো অপরাধ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম। কিন্তু তলিয়ে দেখলে হয়তো অন্য সত্যই সামনে উঠে আসে। বাল্যবিবাহ, শ্বশুরবাড়ির অবেহেলায় কি আড়াল থেকে পশ্রয় দিয়েছিল তারিণীকে? তার অজান্তেই তার অবচেতন মনে হয়তো রেখাপাত করে গিয়েছিল একের পর এক লাঞ্ছনার ঘটনা, যা তাকে পরবর্তীকালে করে তুলল বাংলার অন্যতম নৃশংস সিরিয়াল কিলার! কিন্তু এখানেও প্রশ্ন ওঠে একজন মহিলা হিসেবে তাকে হয়তো তৎকালীন সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে সমাজের সমস্ত অবমাননা সহ্য করতে হয়েছে মুখ বুজে। কিন্তু তার পরেও খুনের জন্য মহিলাদেরই কেন টার্গেট করল তারিণী? নাকি মহিলারাই ছিল তার কাছে সফট টার্গেট? অপরাধ বিজ্ঞানে বারংবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে জ্যাক দি রিপার থেকে জিল দ্য রাই। আর এসবের মধ্যেই আড়ালেই থেকে গেছে বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার তারিণী।
তথ্যসূত্র - ‘বাবু ও বারবনিতা' - দেবারতি মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor