ছোটো থেকেই বন্ধুবান্ধবরা হাসিঠাট্টা করত চেহারা নিয়ে। বেঁটে, মোটা চেহারার ইউরোপা। এমনকি পরিবারের লোকরাও বারবার বলত রোগা হতে। এভাবেই একদিন রোগা হওয়ার উদ্দেশ্যে চলে গেলেন জিমে। না, ওয়েট লিফটিং-এ হাত দেননি তখন। তাতে তো পেশি আরও মজবুত হবে। ইউরোপা তখন সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই ছিপছিপে হতে চেয়েছিলেন। আর তাই হালকা ধরনের ব্যায়াম করতেন। খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন। দুমাসের মধ্যে কমিয়েছিলেন ১০ কেজি ওজন। তাঁর নিজের মনে হয়, তখন যেন অ্যানুরেক্সিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সবসময় তাড়া করত মোটা হওয়ার ভয়। কিন্তু না, সেই ভয় বেশিদিন টিকল না। খুব তাড়াতাড়ি ভালোবেসে ফেললেন জিমকে। আর তারপর? বাকিটা একটা রূপকথা। একটা ইতিহাসের গড়ে ওঠা। বডি বিল্ডিং-এর জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটল একজন বাঙালি মহিলার। ইতিহাসে এই প্রথম। আর তাঁর নাম ইউরোপা ভৌমিক।
পেশি সঞ্চালনার জগতে অবশ্য বাঙালির পরিচিতি নতুন নয়। মনোহর আইচ বা গুণময় বাগচির নাম তো সকলেরই জানা। কিন্তু সেই তালিকায় একজন মহিলার নাম এসে পড়লে সত্যিই অবাক লাগে। বাঙালি মেয়েদের যে ‘লক্ষ্মীমন্ত’ চেহারাতেই চিনতে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু সেই অভ্যস্ত চোখকেই আক্রমণ করেন ইউরোপা ভৌমিক। তিনি চান, মানুষ তাঁর চেহারা দেখে বিব্রত হোক। মাত্র ৪ ফুট ১০ ইঞ্চির শরীরটা নিয়েই মানুষকে অবাক করে দিতে চান তিনি। আর ইতিমধ্যেই সেটা করেও ফেলেছেন।
১৯৯৯ সালে কলকাতার নিউটাউন এলাকায় জন্ম ইউরোপার। বাবা বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাপ্টেন। তাঁর জন্মের সময় বাবা ছিলেন সান্টা ইউরোপা নামের একটি জাহাজে। মেয়ের নাম তাই রাখলেন ইউরোপা। একজন বাঙালির এমন নাম শুনলেও অবাক লাগে। আরও অবাক লাগে সেই মানুষটির বেড়ে ওঠার গল্পে। যে মেয়েটা রোগা হতে জিমে গিয়েছিল, সেই ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলল পেশিসঞ্চালনাকে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সমস্ত সংকোচ সরিয়ে রেখে হাত দিল ওয়েট লিফটিং-এ। একটু একটু করে শক্ত হতে থাকল শরীরের সমস্ত পেশি। সঙ্গে চলল বিশেষ ডায়েট। ওজন হঠাৎ করে বেড়ে গেলেও মুশকিল। আর শরীর গড়ে তোলার কাজে পুরুষ এবং মহিলাদের হরমোনের পার্থক্যের কারণে কিছুটা আলাদা নিয়মও মেনে চলতে হয়। কিন্তু কলকাতায় তো কোনো মহিলা বডি বিল্ডার নেই। তাই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই কারোরই। পুরোটাই চলল পরীক্ষার মতো। দেখতে দেখতে অবশ্য সাফল্য মিলল তাতেই। আর একটু একটু করে নিজের চেহারার বদল দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন ইউরোপা নিজেই।
২০১৫ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইউরোপা নাম দিলেন সতীশ সুগার ক্লাসিকসে। মেয়ে পেশি-সঞ্চালনায় নাম দেবে? প্রথমে যেন ঠিক মেনে নিতে পারেননি অভিভাবকরা। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছায় বাধা দেননি। প্রথমবার অবশ্য পুরস্কার এল না। পরের বছর সেই একই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হলেন তিনি। এবার পরিবারের আপত্তি ভেঙে গেল। বরং তাঁর মা সুপর্ণাই উৎসাহ দিতে শুরু করলেন আরও বেশি করে। ২০১৭ সালে এশিয়া বডি বিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় এবং ২০১৮ সালে ন্যাশানাল বডি বিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় হলেন তিনি। একে একে মিস ফিজিক অলিম্পিয়া, মিস রাইজিং ফিনিক্স সহ সমস্ত আন্তর্জাতিক খেতাবই জয় করতে চান তিনি। কিন্তু এদেশে তার উপযুক্ত পরিকাঠামোই বা কোথায়? তাই তিনি পাড়ি দিয়েছেন মাদ্রিদ শহরে। কিন্তু নিজের শিক্ষা সম্পূর্ণ করে আবারও এদেশে ফিরে আসতে চান তিনি। তিনি চান বাঙালি মেয়েরা নিজেদের শরীর নিয়ে লজ্জা ভুলে তাকে শক্তিশালী করে তুলতে শিখুক। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখানেও এগিয়ে আসতে হবে মেয়েদের। নাহলে লিঙ্গসাম্যের স্লোগানের সার্থকতা কোথায়?
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম মহিলা এয়ার মার্শাল পদ্মাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়, পা রেখেছেন উত্তর মেরুতেও
তথ্যসূত্রঃ বাঙালি মেয়ে বাহুবলী, মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য, এইসময়
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্রয়াত ভারতীয় বায়ুসেনার প্রথম মহিলা কমান্ডার বিজয়লক্ষ্মী রামানন