‘আমি ছিলাম ছবিঘর সিনেমার লাইটম্যান। প্রায় ৩৮ বছর ধরে। বছরের মধ্যে মাস দুয়েক সিনেমা হল বন্ধ থাকত। আর ঠিক বোনাসের সময়েই ব্যাটারা আমাদের ছুটি দিত। ফলে বোনাস হাতে আসত না। সেই সময় ছবি বিক্রি করে চালাতুম…’
গোলপার্ক এক্সিস ব্যাংকের সামনে ছোট্ট টুল পেতে বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। পাশেই ফুটপাথে একটা প্লাস্টিকের চটের উপর রাখা চারটি ছবি। বাঁধাই করা কালো কার্ডবোর্ডের উপর অপূর্ব কারুকাজ। তখন সন্ধে ৭টা। এ-টি-এম কাউন্টারে ঢোকার আগে অনেকেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন দু'দণ্ড। বৃদ্ধের নাম সুনীল পাল। এই এ-টি-এম কাউন্টারের সামনেই তাঁর হাতে আঁকা ছবি বিক্রি করছেন প্রায় ৯-১০ বছর হয়ে গেল। কানে শোনেন না ভালো করে। তাই গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করি, ‘কত দাম?’
‘চারটে পড়ে আছে, বড়োগুলির দাম ১৫০ টাকা। আর ছোটোগুলো আপনি যা দেবেন!’
আলাপ জমে ওঠে ধীরে ধীরে। সুনীলবাবু হাতিবাগানের বাসিন্দা। পরিবারের অন্য সদস্য বলতে গেলে তাঁর মানসিক ভারসাম্যহীন এক পুত্র। প্রতি সপ্তাহে দুটি দিন বেছে নিয়ে তিনি বসেন এ-টি-এম কাউন্টারের সামনে। আশেপাশের অন্য দোকানদারেরা তাঁর নাম রেখেছে, ‘ছবি-বুড়ো'।
আরও পড়ুন
অসংখ্য শিল্পীর প্রথম গিটারের সাক্ষী, সময়ের কোপে ধুঁকছে বাগবাজারের ‘হবনার মিউজিক’
১৯৬৭ সাল থেকে তুলি ধরছেন সুনীলবাবু। বয়স এখন আশি। আগে কাজ করতেন মুগার উপর। তখন মুগার দাম গজপিছু অনেকটাই সস্তা। কাপড়ের দাম বাড়ায় কালো কার্ডবোর্ডই ভরসা তাঁর। ছিলেন ছবিঘর সিনেমার লাইটম্যান। এমনও হয়েছে অনেক সময় সিনেমা চলাকালীন হল থেকে বেরিয়ে ছবি বিক্রি করে ফিরে এসেছেন হলে।
‘তখন সস্তাগণ্ডার বাজার বুঝলেন! আমি মুম্বই গিয়েছিলুম একটা এক্সিবিশনে। ট্রেন ভাড়া ছিল ৪১ টাকা। আর যে হোটেলটায় ছিলুম, সেটায় ঘরের জন্য দিতে হয়েছিল মাত্র ৭ টাকা! তাই আমরাও হাতে পয়সা পেতুম না। এইসব সিনেমা হলের মালিকগুলো আসলে হাড়বজ্জাত। তাই নিজেই বসে পড়লাম, ব্যবসায়। আগে ময়দানের ছবি টাঙিয়ে এক্সিবিশন হত। সেখানেও বার-কয়েক ছবি দিয়েছি... তারপর সব বন্ধ হয়ে গেল…’
আরও পড়ুন
সম্মান নেই ব্যবসায়, সময়ের দৌড়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন ‘ব্যান্ড পার্টি’র শিল্পীরা
একেকটি ছবি আঁকতে সুনীলবাবু সময় নেন এক-দেড় ঘণ্টা। কাঁচা রং শুকোতে লাগে এক-দুদিন। এইরকম সাত-আটটি ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজ চলে। তার মধ্যে কার্ডবোর্ড এবং পেপার ম্যাশ দিয়ে বানিয়ে ফেলেন ফুলদানি। একদিনেই প্রায় চারটি ছবি বিক্রি হয়। আর ফুলদানিগুলো ‘উড়ে যায়' কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। ছবির চিত্রশৈলী তাঁর নিজস্ব। ছবির মধ্যে বেঙ্গল স্কুল বা ‘কাংরা'র দৃশ্যমান ছাপ পাওয়া গেলেও পার্থক্যও রয়েছে চোখে পড়ার মতো। বলা বাহুল্য, প্রথাগত ভাবে ছবি আঁকা কখনো শেখেননি সুনীলবাবু।
‘বুড়ো বয়সে পিঠভাঙা পরিশ্রম! পারেন কীভাবে?’
আরও পড়ুন
টাইপরাইটার দিয়ে ছবি এঁকে চমক বেঙ্গালুরুর শিল্পীর
বৃদ্ধ হাসেন। চোখে খেলে যায় সাতরং।
‘ছবি আঁকছি প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেল। এখন তো হাতে ‘টান-টোন' অভ্যস্ত। তাই আঁকতে বেশিক্ষণ লাগে না। অনেক অনুশীলন করে আমি এই জায়গায় পৌঁছেছি। সারা কলকাতায় এই ‘ডিজাইন' আমি ছাড়া আর কারো কাছে পাবেন না। কথাটা মিথ্যা হলে, আমার থেকে বিনামূল্যে যত পারেন ছবি নিয়ে যাবেন। টাকা দিতে হবে না।'
সুনীলবাবুর স্মার্টফোনও নেই। ইন্টারনেট বোঝেন না। ফেসবুক জগৎ তাঁর কাছে অজানা। সুতরাং তাঁকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে জল্পনা চলছে, তাই নিয়ে তিনি ভাবলেশহীন।
‘লোকের ভালো লাগলে এখানে এসে ছবি নিয়ে যাবে। আপনি নেবেন?'
আপাতত একটি ছবি আমার সংগ্রহে। শিল্পীকে কথা দিয়েছি, খবরটা বেরোলে একবার দেখিয়ে নিয়ে যাব।
Powered by Froala Editor