সিঁথির মোড় থেকে যে রাস্তাটা সোজা বরাহনগর বাজারের দিকে চলে গেছে, সেটি কাশীনাথ দত্ত রোড। সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই ডানদিকে দেখতে পাবেন একটি বাড়ি। নাম ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি লিমিটেড’। প্রথম দর্শনে তেমন কিছু মনে হবে না। সেটাই স্বাভাবিক! জরাজীর্ণ বাড়িটার অনেক জায়গা ভেঙে পড়েছে। বরাহনগর বাজার থেকে খানিক উত্তরে এগোলে আরও একটি বাড়ি পড়বে। এটি অবশ্য পোস্ট অফিস; কিন্তু নাম একই- ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি’। আজকের এই ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস হয়তো মুছে গেছে একেবারে। হারিয়ে গেছেন আরও একজন মানুষ, নরেন্দ্রনাথ দত্ত…
না, যাকে ভাবছেন তিনি নন। সিমলা নয়; এই মানুষটি জন্মেছিলেন কুমিল্লার শ্রীকাইল গ্রামে। সেখানকার খোলামেলা পরিবেশে বড়ো হচ্ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। পরিবারের অবস্থা ভালো নয়; কিন্তু মেধা আর পরিশ্রম কি দারিদ্রে আটকে থাকে? নরেন্দ্রনাথের লক্ষ্য, পড়াশোনা করে নিজের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেন। আরও অনেকের সহায় হবেন তিনি। কিন্তু বাস্তব তো তখন অন্য পথে! রাস্তায় নামলেন নরেন। কাঁধে তুলে নিলেন সবজির ঝুড়ি। গ্রাম থেকে সেসব নিয়ে চলে আসতেন শহরে। স্কুলের মেধাবী নরেন্দ্রনাথ তখন সবজি বিক্রি করছেন। আর পেটে চাগাড় দিয়ে উঠছে খিদে। দুটো দানাও পড়েনি…
পরিশ্রমের দাম পেলেন শীঘ্রই। ১৯০৮ সালে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুযোগ পেয়ে যান কলকাতায়। খোদ মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়বেন তিনি! নরেনের চোখ চকচক করে উঠল। অনেক স্বপ্ন তার পেছনে। পকেটে মাত্র ২৫০ টাকা। কুমিল্লা থেকে চলে এলেন ব্রিটিশদের সাধের রাজধানীতে। বঙ্গভঙ্গের সময়। চারিদিক তখন উত্তাল। ঝড়ে দুলছে নরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনও। কিন্তু তিনি অকুতোভয়…
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল থেকে প্রায় প্রতি রাতেই একজন বেরিয়ে পড়ে। অন্ধকারে হারিয়ে যায় কলকাতার রাস্তায়। আবার ফিরেও আসে ভোরের সময়। ব্যাপারটা অনেকদিন ধরেই কানে আসছিল হোস্টেলের ইংরেজ সুপারের। কী হল? বাজে খপ্পরে পড়ল নাকি? দেখি তো কী হচ্ছে! একদিন চুপিসারে সেই ছাত্রটির পিছু নিলেন হোস্টেল সুপার। ছেলেটি সোজা চলে গেল খিদিরপুরে। ধীরে ধীরে পুরো ছবিটা পরিষ্কার হল। আর যত পরিষ্কার হল, ততই অবাক হলেন সেই সুপার। সেই ছাত্র আর কেউ নন, স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। রাতের বেলা খিদিরপুর ডকে গিয়ে জাহাজ থেকে মাল নামান তিনি। বিনিময়ে জোটে কিছু পয়সা। কিন্তু এমন পরিশ্রম কেন? কারণ, টাকা নেই! মেডিক্যাল কলেজে বৃত্তি পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু দৈনন্দিন খরচও তো রয়েছে। এদিকে বাড়ি থেকেও টাকা পাঠানোর সামর্থ্য নেই। অগত্যা…
অবাক হয়ে গেলেন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। এভাবেও কেউ পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে! সেই জায়গাতেও তো নরেন্দ্রনাথ ছিলেন সেরা। মুগ্ধ হলেন কলেজের প্রিন্সিপাল। এরপর থেকে শুরু হয় এক অন্য অধ্যায়। ডাক্তারি পাশ করার পর মেডিক্যাল কলেজেই হাউস সার্জনের পদে বেশ কিছুদিন কাজ করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তারপর ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের ডাকে পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যে। তখন চলছে ইঙ্গ-তুর্কি যুদ্ধ। সেখানেই লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন নরেন। কিন্তু এই চাকরি যে তাঁর ভালো লাগছে না। কেবল যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা। নয় বছর সেখানে কাজ করেন তিনি; বিনিময়ে পান ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধি। কিন্তু আর নয়। সঙ্গে সঙ্গে চাকরি থেকে ইস্তফা; এবং বাংলায় ফেরার জাহাজ ধরা…
খানিক আগের কথা। ১৯১৯ সাল। স্বদেশি আন্দোলন তখন গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত বিষয় ব্রিটিশদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে কেন? আমরাই তো নিজেদের মেধা, বুদ্ধি ও পরিশ্রম দিয়ে একেকটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারি! সেই ভাবনা নিয়েই একত্র হয়েছিলেন ডাঃ নীলরতন সরকার, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, চারুচন্দ্র বসু প্রমুখ। সেই দলে যোগ দিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তও। যাত্রা শুরু হয় ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি’র। কিন্তু সে যাত্রা ছিল কেবল নামেই। প্রত্যেকে এত বিখ্যাত ও বড়ো ডাক্তার, কেউই সেভাবে সময় দিতে পারছিলেন না। সংস্থার কাজকর্মও বন্ধ হয়ে ছিল। তাহলে? উপায় পেলেন বিধান রায়। তখন দেশে ফিরে এসেছেন ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বিধান রায় তাঁর কাছেই জানালেন সেই বিশেষ অনুরোধ। সংস্থার যাবতীয় দায়দায়িত্ব যেন তিনিই নেন। শুরু হল বাংলার এক অন্য ইতিহাস। বলা ভালো, অজস্র ধুলোর নিচে চেপে পড়া এক অদ্ভুত কাহিনি…
১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বেঙ্গল ইমিউনিটির অফিসটি ছিল কলকাতায়। সবার আগে সেখান থেকে প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে নিয়ে এলেন নরেন্দ্রনাথ। গন্তব্য বরাহনগর। চোদ্দো একর জমি কিনে সেখানেই নতুন করে তৈরি করলেন ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি লিমিটেড’। একটি প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কীভাবে তার চারপাশকেও বদলানো যায়, সেই ধারণাটি দিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ছোটো থেকেই যে ওঁর ইচ্ছা ছিল স্বাধীনভাবে পথ চলার। সবাইকে নিয়ে একটা ছাতা হয়ে ওঠার। বরাহনগরের ওই অঞ্চলে কেবল কারখানাই তৈরি হল না; সঙ্গে এল আবাসন, স্কুল, পোস্ট অফিস। সেই স্কুল আজও আছে, নামটি কেবল বদলে গেছে— বরাহনগর নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দির।
এই চোদ্দো একর জমির ওপরেই শুরু হল নতুন এক অধ্যায়— সিরাম তৈরির অধ্যায়। সাপ, কুকুর-সহ বিভিন্ন প্রাণীর কামড়ে ফলে প্রয়োজন হত প্রতিষেধকের। তাছাড়াও নানা সময় নানা রোগের ক্ষেত্রেও প্রতিষেধকের প্রয়োজন হত। ঘোড়ার রক্ত থেকে তৈরি হত এসব সিরাম। কিন্তু সেভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদন এই দেশে হত না। এখানেই বদল আনলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বেঙ্গল ইমিউনিটি লিমিটেডে তৈরি হতে লাগল একের পর এক সিরাম; আর সেগুলো বিভিন্ন দোকানে বিক্রিও হত। গোটা ভারতে সিরামের বাণিজ্যিক উৎপাদনের শুরুটা দেখেছিল এই বরাহনগর অঞ্চল। দেখিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত…
সেখানেই শেষ ছিল না। কুমিল্লায় স্কুল-কলেজ গড়ে তুলেছিলেন, দেশভাগের সময় নিজে গিয়ে ট্রাস্টি গঠন করেন। যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ না হয়ে পড়ে। দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের ভিড় নেমে আসে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় থাকার জায়গা নিয়ে। মাথা গোঁজার ঠাই নেই কয়েক হাজার মানুষের। পেটে খিদে নেই; অবৈধ কাজকর্ম বেড়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন উদ্যোগ নিলেন ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ। পশ্চিমবঙ্গের বুকে নিজেই শুরু করলেন কম টাকায় আবাসনের প্রকল্প। তাঁর এই ভাবনার জেরেই বহু মানুষ মাথার ছাদটুকু ফিরে পায়।
এত কিছু করলেন; অথচ পেছনে কখন যে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে বুঝতেও পারেননি। হঠাৎ বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানির ওপর নেমে আসে আয়করের ঘা। মামলা শুরু হয়। নিজের সাধের জায়গার এমন অবস্থা দেখতে পারেননি নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ভবিষ্যৎটাও কি দেখতে পাচ্ছিলেন? ১৯৪৯ সালে থেমে যায় হৃদস্পন্দন। অদ্ভুতভাবে, নরেন্দ্রনাথ দত্ত চলে যাওয়ার পরই পতন শুরু হয় বেঙ্গল ইমিউনিটির। উত্তর শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় ছিল এই প্রতিষ্ঠানের জমি। এমনকি, দেরাদুনের মতো জায়গায়ও ছড়িয়ে পড়েছিল। আর আজ? সেসব কিছুই নেই। বরাহনগরের ওই অঞ্চল দিয়ে গেলে পোড়া, ভূতুড়ে বাড়ি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না এই প্রতিষ্ঠানকে। আর ইতিহাস? সে তো কেবল নামেই। সিমলার নরেন্দ্রনাথ দত্তকে বাঙালি কেন, গোটা বিশ্ব চিনে নিল। আর আরেক বাঙালি, ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত? না, তিনি এখন বিস্মৃতপ্রায়। আমরা ভুলে গেছি বেঙ্গল ইমিউনিটিকেও। মানুষের স্মৃতি আর তার ইতিহাস এমনই— বড়ো নিষ্ঠুর…
তথ্যসূত্র –
১) ‘স্মরণীয় মানুষ বরণীয় বাঙালি নরেন্দ্রনাথ দত্ত’, লিটারেসি প্যারাডাইস
২) ‘দত্ত, নরেন্দ্রনাথ’, বাংলাপিডিয়া
Powered by Froala Editor