বিশুদ্ধ মধু-র খোঁজে ঘুরেছেন গোটা দেশ, বন্ধু মৌমাছিরও – বাঙালি গবেষকের ‘মধুর’ গল্প

মধু - এই জিনিসটি খেতে কমবেশি সকলেই ভালবাসেন। শুধু তাই নয়, পুজোর কাজে এবং ওষুধ হিসেবেও এর অন্যতম ব্যবহার। আর মধু বললেই, অবধারিত এসে পড়ে মৌমাছির কথা। কিন্তু আমরা নিজেরা কতটা জানি এদের সম্পর্কে? বর্তমান পৃথিবীতে মৌমাছিরা যে একেবারে সুরক্ষিত নেই, সেটার সম্পর্কে কি অবগত আমরা? এই প্রশ্নগুলোই বিগত দশ বছর ধরে তুলে আসছেন স্বর্ণেন্দু সরকার। সেই সঙ্গে গোটা দেশ জুড়ে কাজ করছেন মধু ও মৌমাছি নিয়ে। যাতে আরও বেশি সচেতনতা ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।

দশ বছর আগে চাকরি ছেড়ে মধু সংরক্ষণের কাজে আসা স্বর্ণেন্দুবাবুর। এডমন্ড হিলারির গল্প শুনে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। সেই নিয়ে পড়াশোনার শুরু, সঙ্গে চলতে থাকে মাঠে নেমে পরিস্থিতি বোঝা। তখনই আবিষ্কার করলেন সিলড মধুর গল্প। নেকটার এবং পরাগ সংগ্রহ করার পর মৌমাছিরা, চাকের নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে সেটাকে জমিয়ে রাখে। প্রাথমিক অবস্থায় এই নেকটার আর্দ্র থাকে অনেকটা। ক্রমাগত ‘ফ্যানিং’ বা ডানা ঝাপটানোর মাধ্যমে কর্মী মৌমাছি সেই ভাবটা কমিয়ে আনে অনেকটা। আর্দ্রতা কমে গেলে (২০%) ওই প্রকোষ্ঠ, মোম দিয়ে আটকে দেয়। এই মধুই হল ‘সিলড’ হানি; যেটা কিনা প্রকৃত মধু। যাতে সমস্ত গুণাবলি, প্রয়োজনীয় মিনারেল থাকে।

বোস ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে পরীক্ষা করে স্বর্ণেন্দুবাবু দেখেন, বাজার-জাত মধুগুলির মধ্যে এরকম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। প্রক্রিয়াকরণের পর এসব মধু আসে বলে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও নেই। এখান থেকেই কাজ শুরু করেন তিনি। গোটা দেশ ঘুরে বেরিয়েছেন এই ‘সিলড’ মধুর জন্য। গ্রামের মানুষদের সাহায্যে তার চাষও করা শুরু হয়, সেই সঙ্গে শুরু হয় বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা।

তাঁর কথায়, “একটা সময় মানুষ এই সিলড মধু, মৌমাছি এবং তার পেছনের পরিবেশের সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এখন তাও একটু একটু করে জানছেন। আরও যাতে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই আমার ইচ্ছা।”

মধুর স্বাদ, তার রং, গন্ধ হরেক রকম হতে পারে। বিদেশে এমন জিনিস দেখা গেলেও, এ দেশে সেরকম দেখা যায় না। স্বর্ণেন্দুবাবু ঠিক সেই পথেই গেলেন। একটি জায়গার ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান, জলবায়ু, ঋতু সমস্ত কিছুর ওপর মধু-র চরিত্র নির্ভর করে। তবে এই চরিত্র নির্ধারণে সবথেকে বেশি দায়ী পোলেন, অর্থাৎ ফুলের পরাগ। এক একটি ঋতুতে এক একরকম ফুল ফোটে। আর আলাদা আলাদা ফুলের জন্য মধুর রং ও স্বাদও নানা রকম হয়। স্বর্ণেন্দু সরকার এই বিস্তৃত মধুদের নিয়েই দেশ জুড়ে কাজ করে চলেছেন। সর্ষে, কালো জিরা, ইউক্যালিপটাস, রোজ উড, তুলসী, ওয়াইল্ড বেরি ইত্যাদির ফুল থেকে নানা রকমের মধু-র ভাণ্ডার রয়েছে তাঁর। এই সব মধুই হল বিশুদ্ধ, সিলড মধু।

তবে শুধু এটাই তাঁর কাজ নয়। মৌমাছিদের নিয়ে, মধু নিয়ে যাতে সমস্ত জায়গায় সচেতনতা তৈরি হয়, সেটাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। “আমার কাজ শুধু মধু বিক্রি বা ওই সংক্রান্ত নয়। কিন্তু মৌমাছি যদি না থাকে তাহলে পৃথিবীতে খাবার জুটবে না। মৌমাছির মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পলিনেটর, সে যদি না থাকে তাহলে তো আমাদেরও সমূহ বিপদ। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ২৪ হাজারের কাছাকাছি মৌমাছির প্রজাতি রয়েছে। আগে আরও ছিল। বেশ কিছু প্রজাতি আজ পৃথিবী থেকে মুছে গেছে চিরতরে। বর্তমানে কিছু প্রজাতির অবস্থাও খারাপ। মুশকিলটা হল, আমরা সাধারণত মৌমাছিকে মাছির মতোই মনে করি। তাই এরা মারা গেলে আমাদের কোনো গ্লানি থাকে না। মাছির সঙ্গে মৌমাছির বিস্তর ফারাক। গুরুত্বও অনেক বেশি। সেটা মানুষের কাছে কোনো কারণে পরিষ্কার নয়। ছোটোবেলায় বিজ্ঞানের বইতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পলিনেটর হিসেবে এই প্রাণীটির নাম আসত। যদি সংখ্যা এইভাবে কমতে আরম্ভ করে, তাহলে শুধু আমরা নই, পরিবেশের ভারসাম্যও ভেঙে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে যাতে সাধারণ মানুষ মৌমাছির গুরুত্ব বোঝে সেটাই চেষ্টা করি আমি।”

হঠাৎ করে কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর পরিবারে সমস্যা হয়নি? প্রশ্নটারই প্রত্যাশায় ছিলেন স্বর্ণেন্দু বাবু। পরিবারের থেকে সাহায্য সব সময় পেয়েছেন। পেয়েছেন বন্ধু বান্ধবদের সাহায্যও। আজ তাঁরাও এই উদ্যোগে সামিল। অবসর সময় লেখালেখিও করেন তিনি। মধু, মৌমাছি নিয়ে পৃথিবীর নানা ইতিহাস, নানা গল্প ও ঘটনা সেখানে ছড়িয়ে থাকে। সেই সঙ্গে থাকে গ্রামের মানুষগুলোর কথা। সবাইকে নিয়েই সচেতনতার লড়াই লড়ছেন স্বর্ণেন্দু সরকার।