মহালয়ার ভোর পেরিয়ে জেগে উঠেছে বাংলা। কাগজে বড়ো অক্ষরে হেডিং ‘পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের সূচনা’। হোক না মল মাস, করোনা পরিস্থিতি; তার মধ্যেও দুর্গা আরাধনা থেকে পিছিয়ে আসেনি কলকাতা। এবার আয়োজন সামান্য হলেও প্রস্তুতি চলছে। শহরের বনেদি বাড়িগুলো নিজ নিজ ঐতিহ্য নিয়ে হাজির হচ্ছে। আর সেই কথা আসলেই মনে পড়ে উত্তর কলকাতার বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ির কথা। প্রতি বছর যে পরিবারের পুজো দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়ে। তবে এর ইতিহাসের সঙ্গে চলতে গিয়ে চোখে পড়বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যার শুরুয়াৎ হয়েছিল পলাশীর ময়দানে…
কথায় বলে ‘শূন্য থেকে শুরু’। শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব সম্পর্কে এই কথাটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। পিতৃহীন অবস্থায় কলকাতার কাছে গোবিন্দপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। বলা ভালো, অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা তাঁর। কিন্তু বুদ্ধি ছিল প্রখর। নিজের চেষ্টায় উর্দু, আরবি, ফার্সি শিখেছিলেন। ইংরেজ সরকারের হয়ে কাজ করার জন্য সমস্ত রকম গুণই তাঁর মধ্যে বর্তমান ছিল। একটা সময় শুরু হল কাজের জগত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য মুনশী হিসেবে জীবন শুরু হয় নবকৃষ্ণ দেবের। সরকারি কাজকর্মের পাশাপাশি ওয়ারেন হেস্টিংসকে ফার্সি ভাষা শেখানোর কাজ করতেন। এমনভাবেই সবটা চলছিল।
এবার আমাদের গল্পের চরিত্র হয়ে উঠে আসবে মুর্শিদাবাদ এবং পলাশী। বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন রবার্ট ক্লাইভ। সিরাজের পক্ষে আছেন মীরজাফর। ক্লাইভ তখন নিশ্চিন্তে। কারণ পেছনের সমস্ত গল্প তাঁর নখদর্পণে। সময়মতো নবাবের পক্ষ ত্যাগ করলেন মীরজাফর। তার পরবর্তী ফলাফল আমাদের সবারই জানা। ‘ইনাম’স্বরূপ মীরজাফর নবাবের গদিতে বসলেন। কিন্তু পেছনে থেকে লাভবান হলেন আরও দুজন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দেব। মীরজাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইতিমধ্যেই তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন সিরাজের গোপন কোষাগার। সবাই সেই বিপুল ধনসম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেন। তা সত্তেও নবকৃষ্ণের ভাগে কম কিছু পড়েনি। দেখতে দেখতে বিশাল ধন দৌলতের মালিক হয়ে গেলেন তিনি। শুধু টাকাই নয়, এল সম্মানও। ইংরেজদের পক্ষ নেওয়ার জন্য পেলেন ‘রাজা বাহাদুর’ খেতাব; অতঃপর ১৭৬৬ সালে ‘মহারাজা বাহাদুর’। সবথেকে বড়ো কথা, গোটা সুতানুটি অঞ্চলের তালুকদার হয়ে গেলেন তিনি। সামান্য মুনশী থেকে বিশাল সাম্রাজ্য ও ধন-দৌলতের মালিক— এমনই চমকপ্রদ উত্থান রাজা নবকৃষ্ণ দেবের। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল শোভাবাজার রাজবাড়ির…
তখন সবে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। নবকৃষ্ণ দেব ভীষণ খুশি। আর এখানেই ধর্মের তাসটি খেললেন চতুর ক্লাইভ। নিজে খ্রিস্টান, মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী; তা সত্তেও নবকৃষ্ণকে বোঝালেন কলকাতায় একটি বিজয় উৎসব করার জন্য। ‘হিন্দু ভাবাবেগ’ রক্ষা পেয়েছে বলে কথা! কিন্তু কীভাবে হবে উৎসব? নবকৃষ্ণ ঠিক করলেন, দেবী দুর্গার আরাধনা করেই তুষ্ট করবেন ক্লাইভকে। শুরু করবেন বিজয় উৎসব। বসন্তকালের দুর্গাপূজাকে নিয়ে এলেন শরৎকালে। ১৭৫৭ সালেই নিজের নবনির্মিত ঠাকুরদালানে শুরু করলেন অকাল বোধন। শুরু হল কলকাতার দুর্গাপূজা। তাতে একশো এক টাকা দক্ষিণাও পাঠিয়েছিলেন ক্লাইভ! বিশাল আয়োজন করে শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। কালে কালে যা শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে…
তবে কলকাতার পুরনো পুজো বললে কেবল শোভাবাজার রাজবাড়ির কথা আসবে না। ইতিহাস হিসেবে বিচার করলে, কলকাতার প্রথম পুজোর দাবিদার কিন্তু সেই বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরাই। তখন কলকাতাকে ঠিক শহর বলা চলে না। সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের মতোই নিছক একটি গ্রাম মাত্র। তার মধ্যেই ১৬১০ সালে আটচালার দুর্গাপূজা শুরু করেন এই পরিবার। আজ চারশো বছর পেরিয়ে গেছে এই পুজো। ইতিহাস বেড়ে উঠেছে হাত ধরাধরি করে। এক এক করে যোগ দিয়েছে শিবকৃষ্ণ দাঁ-এর পরিবার, বাগবাজারের হালদারবাড়ি ইত্যাদি। এভাবেই এগিয়ে যায় সময়। ইতিহাস নতুন করে প্রস্তুতি নেয়। কয়েকদিন পরেই সেজে উঠবে আঙিনা। মন্ত্রোচ্চারণ আর ঢাকের বোলে মেতে উঠবে সবটা। তার মধ্যেই কোথাও রয়ে যাবে ইতিহাসের পদচিহ্ন। বেজে উঠবে পলাশী, ইংরেজদের জয়ধ্বনি।
তথ্যসূত্র-
১. কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ রায়
২. তিন শতাব্দীর শোভাবাজার রাজবাড়ি, সুশান্ত কৃষ্ণ দেব
আরও পড়ুন
মল্লদেব রাজবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু ইতিমধ্যেই, চলবে দেড় মাস ধরে
Powered by Froala Editor