শীতকাল, ডিসেম্বর মাস— এই সবকিছুর সঙ্গে জুড়ে আছে আরও একটি শব্দ। ক্রিসমাস ইভ। ২৫ ডিসেম্বরেই পৃথিবীর বুকে আলো ফেলেছিলেন নাজারেথের যিশু খ্রিস্ট। পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়ে গোটা পৃথিবী মেতে ওঠে উৎসবে। ক্রিসমাস ট্রি, কেক, মিষ্টি, উপহার, আলোর মালা, গির্জায় প্রার্থনা— সব মিলিয়ে এক অন্যরকম পৃথিবী। এক মিনিট, কিছু যেন বাদ যাচ্ছে তালিকা থেকে! আসল মানুষটির নামই যে নেওয়া হয়নি! বড়দিন মানে কেবল যিশুই আসেন না; স্লেজ গাড়িতে চড়ে যে লাল জোব্বা-পরা বৃদ্ধটি আসেন, তাঁর কথা কেমন করে ভোলা যায়। হ্যাঁ, আমাদের সবার প্রিয় সান্টা ক্লজের কথাই হচ্ছে…
লাল পাজামা, জোব্বা, সঙ্গে লাল ‘সান্টা’ টুপি— সেই কবে থেকে সান্টা ক্লজকে এই রূপেই দেখে আসছি আমরা। সান্টা-বুড়ো আসবে, আর ছোটো ছোটো বাচ্চাদের কাছে পৌঁছে দেবে উপহারের ঝুলি। তবে শর্ত একটাই, দুষ্টুমি করা চলবে না। একেবারে ভালো হয়ে থাকতে হবে। তাহলেই রাতের বেলায় এসে, সান্টাদাদু রেখে যাবে লজেন্স এবং পছন্দমতো উপহার। বড়োদিনের মূল উৎসবটি খ্রিস্টানদের হলেও, সান্টা কিন্তু সবার। তাই তো বড়োদিনের রাতে প্রতিটা শিশুর স্বপ্নে ধরা দেন উনি…
সেই আদ্যিকাল থেকেই কি সান্টার এমন রূপ? এমন লাল পোশাকে, স্লেজ চড়ে হাজির হন? তা কিন্তু নয়। আর এর পেছনেই রয়েছে এক মজাদার কাহিনি। সেখানে আসার আগে একটু পাদপূরণ করে নেওয়া যাক। যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুর পর একটু একটু করে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটতে থাকে। বাইবেলের কাহিনিগুলি সবার মধ্যে ছড়াতে থাকে। কিন্তু খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে, বাইবেলের ভেতরে সান্টা ক্লজের অস্তিত্ব নেই। তাহলে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে চোখ রাখতে হবে যিশুর জন্মের প্রায় তিনশো বছর পরে। তখন সেন্ট নিকোলাস বলে এক খ্রিস্টান পাদ্রির কথা জানা যায়। দুঃস্থ, গরীব পরিবারদের সাহায্যের জন্য সবসময় এগিয়ে আসতেন তিনি। বিশেষ করে, ছোটো ছোটো বাচ্চাদের খুবই স্নেহ করতেন। শিশুদের তো বটেই; যাঁদের প্রয়োজন তাঁদেরকেও উপহার ও অর্থ দিতেন তিনি। এই সেন্ট নিকোলাসের চরিত্রই পরবর্তীকালে সান্টা ক্লজ হয়ে যায় বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা।
একটু একটু করে বিশ্ব ইতিহাসের এক অঙ্গ হয়ে ওঠে এই চরিত্রটি। কিন্তু চিরটাকাল একই রূপ থাকেনি তাঁর। প্রথমে স্কেচেই সান্টার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। আজকের মতো ভারী চেহারায় নয়; বরং প্রাচীন সেই সান্টা ছিল বেশ শীর্ণকায়। স্লেজে চড়ে আসতেন বটে, কিন্তু তাঁর বাড়ি তখনও মেরু অঞ্চলে ছিল না। আর জামা? লাল নয়, পরেরদিকে রঙিন ছবি আঁকা শুরু হলে সান্টাকে দেখা যায় নীল এবং সবুজ রঙের জোব্বা পরে থাকতে।
একটু একটু করে বদলটা আসতে থাকে; তবে ছবিতে নয়, লেখায়। ১৮২৩ সাল। নিউ ইয়র্কের ট্রয় সেন্টিনেল পত্রিকায় একটি কবিতা ছাপা হয়, নাম ‘আ ভিজিট ফ্রম সেন্ট নিকোলাস’। লেখাটি কে লিখেছিলেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক। কেউ বলেন ক্লিমেন্ট ক্লার্ক মুরের, কারোর আবার মত হেনরি লিভিংস্টোন জুনিয়রের। যিনিই লিখে থাকুন না কেন, এই কবিতার হাত ধরেই আধুনিক সান্টার একটা রূপ সামনে আসে। এই কবিতায় সান্টার বেশে হাজির হন স্বয়ং সেন্ট নিকোলাস। গোটা শরীর ফারে আচ্ছাদিত, ধবধবে সাদা দাড়ি; সঙ্গে বিস্তর খেলনা, খাবার, মিষ্টি। তবে সবথেকে লক্ষণীয় বিষয় হল নিকোলাসের বর্ণনা। শীর্ণ নন; বরং তাঁকে বলা হয়েছে ‘a broad face and a little round belly’। সেইসঙ্গে উজ্জ্বল চোখ আর লাল টুকটুকে মুখ।
আরও পড়ুন
সান্টা নয়, এই দেশে ক্রিসমাসের সময় হাজির হয় ভয়ালদর্শন মানুষরা!
চেহারার বর্ণনার সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে ভালোই। কিন্তু পোশাক? তখনও লাল রং আসেনি। এমনকি ১৮৬৪ সালেও একটি পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, হলুদ পোশাক পরে বসে আছে সান্টা ক্লজ। আসল বদল এল ১৮৭০-এ। আমেরিকান কার্টুনিস্ট থমাস নাস্ট সান্টা ক্লজের একটি ছবি আঁকলেন। এবং এই প্রথমবার দেখা গেল, সিগনেচার লাল জোব্বা, পাজামা আর টুপি পরে আছেন সান্টাবুড়ো। থমাস নাস্টের একের পর এক ছবিতে দেখা যাচ্ছে এই সান্টাকেই। কিন্তু সেভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না এই ছবিটি। লাল ছাড়াও অন্য রং চলে আসছে অন্যান্যদের ছবিতে…
সার্বজনীন বদলটা এল ১৯৩১ সালে। বিশ্ববিখ্যাত সফট ড্রিংকস কোম্পানি কোকাকোলা নিজেদের নতুন বিজ্ঞাপন প্রকাশ করল। এবং এই প্রথমবার বাণিজ্যিক জায়গায় আত্মপ্রকাশ করল সান্টা ক্লজ। কোকাকোলার সেই বিজ্ঞাপনেই বেরোল সান্টা ক্লজের লাল পোশাক পরা ছবি। শুধু পোশাকই নয়; চেহারাতেও এখনকার আদল। সেই সাদা দাড়ি, সাদা চুল, মাথায় সান্টা-টুপি; আর একগাল হাসি। এই ছবিটি এঁকেছিলেন অন্য এক আমেরিকান শিল্পী হ্যাডন সান্ডব্লম।
এবং এখান থেকেই ছবিটা বদলে গেল পুরোপুরি। গোটা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল সান্টা ক্লজের এই রূপ। তারপর থেকে আর বদল হয়নি। রংও বদলায়নি, কিছুই হয়নি। সান্টা থেকে গেছেন সেই আগের মতো। ক্রিসমাস ইভের দিন ঝোলাভর্তি উপহার নিয়ে চলে আসবেন যথারীতি। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মুখও ঝকমক করে উঠবে…
আরও পড়ুন
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, কৃষ্ণাঙ্গ সান্তা ক্লজের জন্ম দিয়েছিল মার্কিন প্রদেশ
তথ্যসূত্র-
১) ‘কেন লাল পোশাকেই দেখা যায় সান্টাকে? শিশুদের কেন উপহার দেন তিনি?’, শ্রমণা রায়, এই সময়
২) ‘Why is Santa Red? You asked Google- here’s the answer’, Stephen Moss, The Gurdian
Powered by Froala Editor