মাথায় মুগুর মেরে বলি, পেরুর প্রথম মমির সঙ্গে জড়িয়ে এমনই আশ্চর্য ইতিহাস

মাস খানেক আগের কথা। পেরুর পুমো শহরের এক যুবকের থেকে উদ্ধার হয় আস্ত একটি মমি। যার বয়স প্রায় ৫০০-৬০০ বছর। খাবার সরবরাহ করার ব্যাগে মমিটিকে বন্দি করেই জনাকীর্ণ অবস্থায় মদ্যপান করছিল ওই যুবক। মজার বিষয় হল, গ্রেপ্তারের পর অভিযুক্ত যুবক দাবি করে মমিটির নাম ‘হুয়ানিতা’। সে নাকি তার আধ্যাত্মিক বান্ধবী।

না, মমিকৃত মানুষটির নাম আদতে ‘হুয়ানিতা’ ছিল কিনা— সে-ব্যাপারে এখনও কোনো তথ্যের হদিশ পাননি গবেষকরা। তবে এই গল্প সদ্য-আবিষ্কৃত মমিটিকে নিয়ে নয়। বরং, এই গল্পের নায়িকা আরেক ‘হুয়ানিতা’ (Juanita)। সে-ও পেরুভিয়ান মমি। তার বয়সও প্রায় ৫০০ বছর।

পেরু আর মমি— এই দুটি শব্দকে পাশাপাশি দেখে হয়তো অবাক হচ্ছেন অনেকেই। মমি বলতেই যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিশরের ছবি। তবে মমি তৈরির চল ছিল লাতিন আমেরিকার দেশ চিলিতেও। পাশাপাশি মমির দৌড়ে পিছিয়ে নেই পেরুও। তবে অন্যান্য দেশের মমিদের থেকে পেরুভিয়ান মমি সম্পূর্ণ ভিন্ন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি করা হয়নি এই মমিগুলিকে। বরং, এক্ষেত্রে মমিকরণের দায়িত্ব নিয়েছিল খোদ প্রকৃতিই।

এবার মূল গল্পে ফিরে আসা যাক। ১৯৯৫ সাল। পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার মাউন্ট আম্পাটো শৃঙ্গ অভিযানে পাড়ি দিয়েছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক জোহান রেইনহার্ড এবং তার সহকর্মী মিগুয়েল জারাতে। তুষারাবৃত পর্বতে হাঁটতে গিয়েই তাঁরা হোঁচট খান একটি মৃতদেহে। প্রাথমিকভাবে তাঁদের মনে হয়েছিল, এই মৃতদেহ হয়তো দুর্ঘটনার শিকার হওয়া কোনো পর্বতারোহীর। তবে বরফের চাদর সরিয়ে মৃতদেহটিকে বের করে আনতেই চমকে ওঠেন জোহান এবং মিগুয়েল। পেশায় প্রত্নতাত্ত্বিক হওয়ায় বুঝতে অসুবিধা হয়নি শুকিয়ে যাওয়া দেহটির বয়স কয়েকশো বছর।

হ্যাঁ, আজ থেকে ২৮ বছর আগে আন্দিজে আবিষ্কৃত এই মমিটির নামও ‘হুয়ানিতা’। আর ‘হুয়ানিতা’-ই সে-দেশে আবিষ্কৃত প্রথম মমি। কিন্তু মিশর কিংবা পেরুর মমির থেকে কেন ‘পৃথক’ এই মমি? পেরুর এই মমির ইতিহাসই বা কী?

১৯৯৫ সালের সেই আকস্মিক আবিষ্কারের পর থেকেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেন গবেষকরা। আর তারপরই মাউন্ট আম্পাটো থেকে আবিষ্কৃত হয় একের পর এক মমি। সঙ্গে বিভিন্ন পোশাক, সোনার অলঙ্কার, মৃৎপাত্র, প্রাচীন দানাশস্য, লামার হাড়, কাঠের তৈরি পুতুল ইত্যাদি সামগ্রী। তবে এসব মৃতব্যক্তির জন্য নয়, বরং ঈশ্বরের জন্যই নিবেদন করত প্রাচীন পেরুভিয়ানরা। আরও বিশেষ করে বলতে গেলে পেরুর ইনকা সভ্যতার মানুষরা।

মিশরের মমিদের থেকে এখানেই আলাদা পেরুতে আবিষ্কৃত মমিগুলি। মিশর কিংবা চিলিতে যে-সকল মমি পাওয়া গেছে এখনও পর্যন্ত, তাদের মৃত্যু হয়েছিল স্বাভাবিকভাবে। আর মমি তৈরির প্রথা ছিল মূলত সমাধিস্থ করার একটি রীতি মাত্র। অন্যদিকে পেরুতে আবিষ্কৃত মমিদের ‘বলি’ দিয়েছিল প্রাচীন ইনকা সভ্যতার মানুষরা। ইনকা সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি রীতি ছিল ‘নরবলি’। দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নরবলির আয়োজন করত ইনকার মানুষরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলি দেওয়ার পর সেইসব দেহ পুঁতে ফেলা হত মাটির মধ্যে। কখনও তার ওপর গড়ে তোলা হত মন্দির। আবার কখনও এইসব দেহ পাহাড়ের উঁচু শৃঙ্গে রেখে আসা হত দেবতার জন্য।

‘হুয়ানিতা’-র ক্ষেত্রেও ঘটেছিল এই একই ঘটনা। হুয়ানিতার দেহের সঙ্গেই একাধিক প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার করেছিলেন গবেষকরা। আর সেখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় ‘হুয়ানিতা’-কে বলি দেওয়া হয়েছিল ‘ক্যাপাকোচা’ উৎসবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে এবং ফসলের উৎপাদন নিশ্চিত করতে এই বিশেষ উৎসবে পালন করতেন ইনকারা। প্রার্থনা করতেন দেবতার কাছে। নৈবেদ্য দেওয়া হয় নরবলির মাধ্যমে।

গবেষণা বলছে, শারীরিক দিক থেকে সবচেয়ে নিখুঁত ব্যক্তিকে বেছে নেওয়া হত বলির জন্য। বলির প্রায় এক বছর আগে থেকে রাজকীয় পরিচর্যায় রাখা হত তাকে। হুয়ানিতার ক্ষেত্রেও হয়েছিল তেমনই। বলির ঠিক একবছর আগেই বদলে গিয়েছিল তার যাপন, খাদ্যাভ্যাস। ৫০০ বছরের প্রাচীন এই মমির চুলের আইসোটোপিক বিশ্লেষণই তার অন্যতম প্রমাণ। গবেষকরা লক্ষ করেন, বলির এক বছর আগে থেকে দুধ, মাংস এবং ভুট্টা খাওয়া শুরু করেন হুয়ানিতা। যা মূলত ইনকাদের কাছে ছিল রাজকীয় খাদ্য। তার আগে পর্যন্ত সাধারণ দানাশস্য আলু এবং শাকসবজি খেয়ে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই দিন কাটতে তার।

পাশাপাশি হুয়ানিয়ার পেটে হদিশ মিলেছিল ভুট্টা ও কোকা পাতা দিয়ে তৈরি একধরনের বিশেষ আলোকোহলজাতীয় পানীয়ের। অনুমান করা হয়, বলি দেওয়ার আগে এইধরনের মাদক পান করিয়ে অজ্ঞান করা হত ইনকাদের। তারপর কাঠ বা পাথরের তৈরি ভারি মুগুর দিয়ে আঘাত করা হত মাথায়। হুয়ানিতার সিটি স্কান ও এক্স-রের ক্ষেত্রেও ধরা পড়েছিল এই বিষয়টি। ভারি মুগুরের আগেতেই ভেঙে গিয়েছিল তার করোটি। ব্রেন হ্যামারেজ হয়েই প্রাণ হারিয়েছিল হুয়ানিতা। তারপর তার দেহ রেখে আসা হয় পর্বতচূড়ায়। ঠান্ডা পরিবেশ এবং তুষারপাতে তারপর প্রাকৃতিকভাবেই সংরক্ষিত হয় তার মৃতদেহ। হয়ে ওঠে মমি।

আশ্চর্যের বিষয় হল, হুয়ানিতাকে যখন বলি দেওয়া হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১২-১৫ বছর। হুয়ানিতার মমিই প্রমাণ করে ইনকা সভ্যতায় প্রাপ্ত বয়স্কদের সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদেরও বলি দেওয়া হত সমানভাবে।

হুয়ানিতার পর পেরু জুড়ে আবিষ্কৃত হয়েছে এ-ধরনের অসংখ্য মমি। তবে ইতিহাসের এক আশ্চর্য অধ্যায় হয়েই রয়ে গেছে ‘হুয়ানিতা’। পেরুর এই ‘প্রথম’ মমি দেখতে আজও হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমান আম্পাটো শহরের নিকটবর্তী আরেকুইপার ‘মিউজেও সান্টুয়ারিওস অ্যান্ডিনোস’-এ।

Powered by Froala Editor

Latest News See More