১৯১১ সাল। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় হাজির হয়েছেন সমস্ত মান্যগণ্য নেতারা। সদ্য বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঝড় দেখেছে শহর। এখনও যে থেমে গেছে সব, তা তো নয়। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে কংগ্রেসের ২৬তম অধিবেশন। ঠিক হল, এই অধিবেশনে গান গাইবেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিতীয় দিন প্রত্যাশামতো এলেন গুরুদেব; সঙ্গে সরলা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ আরও বেশ কয়েকজন। কয়েকদিন আগেই একটি গান রচনা করেছেন কবি, সমবেত কণ্ঠে সেটাই বেজে উঠল ভারতের বুকে। বেজে উঠল ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা’…
১০৯ বছর পর আজকের ভারতের বুকে উঠে এল আরও একটি ডিসেম্বর। এবং তার হাত ধরে ‘জন-গণ-মন’। সেদিনের গানটির প্রথম স্তবকটি আজ জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে। তাহলে আবারও নতুন করে কেন আলোচনায় এই গানটি? কারণ, ভারতের বর্তমান শাসক দলের এক বর্ষীয়ান সাংসদ, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী ‘জাতীয় সঙ্গীত বদলের ইচ্ছা’ প্রকাশ করেছেন! সেই আবেদন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অফিসেও পৌঁছে দিয়েছেন; পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্লসিত হয়ে পোস্টও করেছেন নিজের বক্তব্য। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক।
অবশ্য এটাই যে বিতর্কের শুরু, তা কিন্তু নয়। ১৯৩৭ সাল। স্বাধীনতা না এলেও, সেই শুভক্ষণ যে আর বেশি দূরে নেই তা বুঝতে পারছিলেন সবাই। এমন পরিস্থিতিতেই কলকাতায় শুরু হয়েছে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠক। আর সেখানেই শুরু হল সমস্যা। ‘বন্দে মাতরম’, না ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক’— কোনটি হবে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত এই নিয়ে চলল বিতর্ক। স্বাধীনতার আন্দোলনে ‘বন্দে মাতরম’-র অবদান তো অস্বীকার করা যাবে না। বিপ্লবী থেকে স্বদেশি, সাধারণ মানুষ— সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এই মন্ত্র। অন্যদিকে ‘জন-গণ-মন’র মধ্যে সমগ্র ভারতের এক ছবি ফুটে উঠেছে। সেখানে ধর্ম-জাতি-অঞ্চলের কোনো ভেদ নেই। তাহলে কোনটি হবে জাতীয় সঙ্গীত?
রবীন্দ্রনাথের গানটি নিয়ে এর আগেও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। সংবাদপত্রের একাংশের দাবি ছিল, ১৯১১-তে সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক ও ভারত-আগমনের জন্য নাকি কবিগুরু এই গানটি রচনা করেন। দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই মনে করে এসেছে ভারতের একাংশ। ১৯৩৭ সালে এসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে ঠিক একই প্রশ্ন করেছিলেন এক তরুণ, পুলিনবিহারী সেন। সেই চিঠির উত্তরেই নিজের সমস্ত মতামত স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন কবি। পুরো লেখাটা পড়লে কখনই মনে হবে না যে, এটি ব্রিটিশ রাজপরিবারের স্তুতিমন্ত্র। বরং সমগ্র রচনাটিই এক অখণ্ড ভারতাত্মাকে তুলে ধরে; সেই সম্প্রীতি, সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করে…
আরও পড়ুন
১২ বছর ধরে ফেলে দেওয়া জাতীয় পতাকা সংগ্রহ করেন হাওড়ার প্রিয়রঞ্জন
এবার আসা যাক ’৩৭-র ওই অধিবেশনের কথায়। ‘বন্দে মাতরম’-কে জাতীয় সঙ্গীত করার কথা ভেবেছিলেন অনেকে, কিন্তু আপত্তি ওঠে অন্য মহল থেকে। জাতীয় মন্ত্র হিসেবে এটি ঠিক আছে; কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের ঐক্যের বাণী এখানে ফুটে উঠছে না। তাহলে? অগত্যা সমাধান এক জায়গাতেই। জওহরলাল নেহরু ছুটলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। উল্লেখ্য, কংগ্রেসের অধিবেশনেই ‘বন্দে মাতরম’-এ সুর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯৩৭ সালেই এক দীর্ঘ চিঠিতে নিজের বক্তব্য জওহরলালকে জানান রবি ঠাকুর। স্বাধীনতার মঞ্চে ‘বন্দে মাতরম’-র অবদান, বিপ্লবী মন্ত্র হিসেবে একে অস্বীকার করা যাবে না কখনই। কিন্তু ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এটিকে দেখা যায় না। সর্বধর্মের মিলনমঞ্চ এই দেশ; আর বঙ্কিমের ওই রচনা কোনোভাবে সেই ছবিটাকে তুলে ধরছে না। পরবর্তীকালে ১৯৩৭ সালেই সুভাষচন্দ্র বসুকে লেখা একটি চিঠিতেও একই কথা বলেন রবীন্দ্রনাথ— “আনন্দমঠ উপন্যাসটি সাহিত্যের বই, তার মধ্যে এই গানের সুসংগতি আছে। কিন্তু যে রাষ্ট্রসভা ভারতবর্ষের সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র সেখানে এ গান সার্বজনীন ভাবে সংগত হোতেই পারে না।”
আরও পড়ুন
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ, কলকাতার বুকেই তৈরি ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা
রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যকেই সমর্থন জানান কংগ্রেস নেতারা। শেষ পর্যন্ত ‘জন-গণ-মন’কেই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। তাও সম্পূর্ণ লেখাটি নয়; রবি ঠাকুরের কথা অনুযায়ী, প্রথম স্তবকটিই হয়ে ওঠে ভারত রাষ্ট্রের মহামন্ত্র। কেবল রবীন্দ্রনাথই নন; বিদেশের অনেক মনীষী, দেশের অনেক নেতাও এই গানে সম্মতি দেন।
স্বয়ং রচয়িতা যখন এই কথা বলছেন, সেই সময় দেশের সমস্ত নেতা যখন একে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, তাহলে আজ কেন বিতর্ক উঠছে? শাসক দলের ওই সাংসদের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘জন-গণ-মন’য় ‘সিন্ধু’ শব্দটি আছে; আর দেশভাগে দীর্ণ দেশের মানচিত্রে তো সেই সিন্ধুর অস্তিত্ব নেই! অবশ্য এটাই প্রথমবার নয়। ২০১৫ সালে রাজস্থানের তৎকালীন গভর্নর কল্যাণ সিং বলেছিলেন, জাতীয় সঙ্গীত থেকে ‘অধিনায়ক’ শব্দটি বাদ দিতে। বারবার একটি নির্দিষ্ট অংশের আক্রমণের বস্তু হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সৃষ্টি। কেন? কাকে কাবু করার চেষ্টা করা হচ্ছে? ইতিহাসকে অস্বীকার করে মনগড়া কিছু তৈরির চেষ্টা? ‘হীরক রাজার’ সাম্রাজ্যের মতো? অথচ প্রকৃত ইতিহাসের দিকে কারোর নজর ফেরে না। এসব কথা ওঠা মানে যে আমাদের অতীতকে অসম্মান জানানো, অমর্যাদা দেওয়া— সেই বোধটুকুও কি হারিয়ে গেছে আজ? জাতীয় সঙ্গীতকে ‘বদলানোর চিন্তা’ হয়তো এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে; আর দেশপ্রেম? সেই সংজ্ঞাও যে বদলে গেছে আগেই…
আরও পড়ুন
১৯৪৭-এ উত্তোলিত প্রথম জাতীয় পতাকা এখন কোথায় জানেন?
Powered by Froala Editor