২৮ জুন, ১৯৬৯ : সমকামীদের ওপর পুলিশি বর্বরতা আমেরিকায়, জন্ম নিল প্রাইড আন্দোলন

/৯

২৮ জুন, ১৯৬৯। আজ থেকে ঠিক ৫২ বছর আগের এক রাত। নিউইয়র্ক শহরের উপকণ্ঠে গ্রিনউইচ ভিলেজের একটি বারে আচমকা হানা দিল পুলিশ। না, মধুচক্র বা মাদক পাচারের কোনো অভিযোগ ছিল না। তবে পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী এই বারে আসতেন শুধুই সমকামী পুরুষরা।

/৯

মাত্র ৫ দশক আগেও আমেরিকায় সমকাম ছিল আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সরকার বিপজ্জনক গোষ্ঠীগুলির যে তালিকা তৈরি করে তাতে কমিউনিস্ট এবং নৈরাজ্যবাদীদের পাশাপাশি নাম ছিল সমকামীদেরও। লম্বা চুলের পুরুষ এবং ছোট চুলের মহিলা দেখলেই সন্দেহের চোখে দেখত প্রশাসন।

/৯

তবে এসবের মধ্যেই ধীরে ধীরে নিজেদের জন্য পৃথক একটা জগত তৈরি করছিলেন সমকামীরা। ৫০-এর দশকে হিপহপ আন্দোলন এবং তারপর বিট সাহিত্য আন্দোলন সমকামের সপক্ষে প্রচারকে আরও জোরদার করে তোলে। গ্রিনউইচ ভিলেজকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সমকামীদের ঘাঁটি। এর মধ্যে অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং উইলিয়ম বরোজের মতো সাহিত্যিক গ্রিনউইচে থাকতে শুরু করলে জনসমর্থন অনেকটাই বাড়তে থাকে।

/৯

তবে পুলিশের খাতায় তখনও সমকাম অবৈধ। শুধু তাই নয়, প্রশাসনিক কর্তাদের মধ্যেও বাসা বেঁধেছিল নানা কুসংস্কার। আর এই পারস্পরিক দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠল ২৮ জুন, ১৯৬৯-এ। স্টোনওয়েল বারে পুলিশের অতর্কিত হামলা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে এলেন আশেপাশের সমস্ত প্রতিবেশীরা। সব মিলিয়ে রীতিমতো দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হল।

/৯

পরদিন সকালেই গ্রিনউইচ ভিলেজের গে অ্যাক্টিভিস্ট ক্রেইগ রডওয়েলের উদ্যোগে ৫ হাজার লিফলেট বিতরণ করা হয় সারা নিউইয়র্ক শহরজুড়ে। উঠে এল ইতিপূর্বে সমকামীদের উপর ঘটে যাওয়া নানা পুলিশি বর্বতার ছবিও। কুপার্স ডু-নাট দাঙ্গা কম্পটন ক্যাফেটেরিয়া দাঙ্গার কথাও উঠে এল একইভাবে। নিজেদের মতো করে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকারই ছিল আন্দোলনকারীদের একমাত্র দাবি।

/৯

সেই রাতেই প্রথম স্টোনওয়েল ইনে প্রবেশ করেন রূপান্তরকামীরাও। শুধু তাই নয়, সমকামী আন্দোলনের সঙ্গে রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকারের প্রশ্নটিও সামনে উঠে আসে। আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন ‘ড্র্যাগ কুইন’ মার্শা পি জনসন। মার্শা ও তাঁর বান্ধবী সিলভিয়ার নেতৃত্বে পরে তৈরি হয়েছিল স্ট্রিট ট্রান্সভেসাইট অ্যাকশন রেভলিউশনারিজ নামের একটি সক্রিয় সংগঠন। লিঙ্গপরিচয়ের কারণে কাজ না পাওয়া সমস্ত মানুষের জন্য তৈরি করেছিলেন নিঃশুল্ক আবাসন।

/৯

আন্দোলনের ভিতর দিয়েই গড়ে উঠল ‘গে লিবারেশন ফ্রন্ট’। পরের কয়েক মাস ধরে গোটা আমেরিকাজুড়ে গড়ে উঠল এমন অনেক সংগঠন। সেই বছরই ডিসেম্বর মাসে তৈরি হল একটি কেন্দ্রীয় মঞ্চ, ‘গে অ্যাক্টিভিস্ট অ্যালায়েন্স’। সমকামীদের দাবির সঙ্গেই যুক্ত হল বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনও। কিউবার সমকামীদের বাধ্যতামূলক শ্রমের প্রতিবাদেও আন্দোলন গড়ে উঠল আমেরিকায়।

/৯

শুধুই প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে নয়, আন্দোলনকারীদের লড়তে হয়েছিল তৎকালিন চিকিৎসকদের সঙ্গেও। মনোবিদরা বিশ্বাস করতেন সমকাম একধরণের মানসিক অসুখ। এমনকি এই রোগের চিকিৎসার জন্য বৈদ্যুতিক শক থেকে শুরু করে আরও নানাধরণের অমানবিক পদ্ধতিও নেওয়া হত। এই সমস্ত জড়তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছিল স্টোনওয়েল ইনের দাঙ্গা। পরের বছরই এই দিনটিকে মাথায় রেখে ‘প্রাইড মার্চ’-এর আয়োজন করে সমকামী সংগঠনগুলি। দেখতে দেখতে পৃথিবীর নানা দেশে শুরু হয়ে যায় ‘প্রাইড মার্চ’-এর আয়োজন। আর অলিখিতভাবেই জুন মাস ‘প্রাইড মান্থ’ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়।

/৯

আজ ৫২ বছর পর গ্রিনউইচ ভিলেজে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটি মনুমেন্ট। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন মার্শা এবং সিলভিয়াও। ২০১৫ সালে এই মনুমেন্ট তৈরি হয়েছে সারা পৃথিবীর সমকামী ও রূপান্তরকামী মানুষদের লড়াইকে সমর্থন জানিয়েই। ২০১৯ সালে ৫০ বছর আগের ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছে নিউইয়র্ক প্রশাসন। আমেরিকা তো বটেই, পৃথিবীর অনেক দেশেই আজ সমকাম আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু এর জন্য কম রক্ত ঝরেনি। আজও তো লড়াই চলছে। স্বাধীন মানুষের মতো বাঁচার সার্বিক অধিকার অর্জনের রাস্তাটা যে এখনও অনেকটা বাকি।

Powered by Froala Editor

More From Author See More