যন্ত্রের এক টানে নেমে যেত মঞ্চ, এমনই ছিল উত্তর কলকাতার সারকারিনার ‘ম্যাজিক’

কলকাতার ঐতিহ্যশালী রাস্তা বিডন স্ট্রিট। রাস্তা বরাবর হাঁটলে পাশে এসে দাঁড়াবে কত শত ইতিহাস। আশেপাশের পুরনো বাড়িগুলো হয়তো কোনো না-বলা কথা নিয়ে বসে আছে। সেরকমই একটি পুরনো, রং চটে যাওয়া বাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালেন আপনি। বাইরে থেকে বাড়িটি দেখে সেরকম কিছুই মনে হবে না। ভেতরে ঢুকলেও একই রকম মনে হতে পারে; কিন্তু একটু মন দিয়ে দেখলে কিছু বিশেষত্ব নজরে আসবে। তারপর কোনো একসময় বাড়িটিই ফিসফিস করে বলে উঠবে তার কথা। জ্বলে উঠবে অডিটোরিয়ামের লাইট, পর্দা সরবে সামনে। আর পুরনো ঝলমলে দিনের স্মৃতি নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে সারকারিনা। উত্তর কলকাতার থিয়েটার পরম্পরার শেষতম নাম… 

হাতিবাগান এবং তার আশেপাশেই রয়েছে স্টার, মিনার্ভার মতো বিখ্যাত থিয়েটার হল। তাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস কলকাতার ভেতরে মিশে গেছে। সারকারিনা সেই তুলনায় অনেকটাই নবীন। ১৯৭৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু হয় এই থিয়েটারের। কিন্তু সময় তো স্রেফ কিছু সংখ্যা। নিজের বৈচিত্র্যে, অভিনবত্বে অন্যান্যদের থেকে খানিক আলাদাই ছিল এটি। সারকারিনার ভেতরে ঢোকার পর সবটাই ছিল ঝলমলে। শোম্যানদের রাজত্ব ছিল এই ঘরে। বলা ভালো, সারকারিনা বলতে একটাই কথা তখন মাথায় আসত সবার— বিনোদন। বাকিরা যা খুশি মনে করুক; এটাই হবে এখানকার বৈশিষ্ট্য! 

এমন পরিকল্পনা নিয়ে নিজের বাড়ির ভেতরেই সারকারিনার যাত্রাপথ শুরু করেছিলেন অমর ঘোষ। সত্তর দশক থেকে নব্বই পর্যন্ত রমরমিয়ে চলত এই থিয়েটার। নিজেই নাটক লিখতেন অমরবাবু। ঠিক নাটক বলতে আমরা যেটা বুঝি, তেমনটা এখানে হত না। আজকের আর্ট সিনেমা বনাম কমার্শিয়াল সিনেমার যে দ্বন্দ্ব আমরা দেখছি, সেই যুগে থিয়েটারে সেই ব্যাপারটা নিয়ে এসেছিল সারকারিনা। যেখানে বিনোদনই শেষ কথা। সপ্তাহে তিনদিন একেবারে হাউজফুল ছিল সেই হল। 

তবে নাটকের সঙ্গে আরও একটা জিনিস ছিল সারকারিনার আকর্ষণ। বলা ভালো, সেটাই অন্যান্য থিয়েটার থেকে আলাদা করেছিল তাকে। রিভলভিং মঞ্চ। চারিদিকে গোল হয়ে বসে থাকত দর্শকরা; আর মাঝখানের গোলাকার মঞ্চটি হঠাৎ নেমে যেত নিচে। কিছুক্ষণ পর ফাঁকা স্থানে আবার উঠে আসত গোটা মঞ্চ; সঙ্গে নতুন সেট, অভিনেতারা। আবার দৃশ্য পরিবর্তনের সময় নেমে যেত মঞ্চ, এবং তারপর একই ব্যাপার। এই ব্যাপারটাই তৈরি করেছিল একটা ম্যাজিকের। সারকারিনার ম্যাজিক। ঝাঁ চকচকে আলোয় যা ঝলসে উঠত… 

সেসব সময় পেরিয়ে এসেছে কলকাতা। এখন সেই আলোর ঝলকানি স্রেফ সুখস্মৃতি। আজকের সারকারিনাকে দেখলে সেই সময়ের রূপ কল্পনা করা একটু কঠিনই বটে। শো বন্ধ হয়েছে বহুদিন। বাইরে তো বটেই, ভেতরের অবস্থাও ভগ্নপ্রায় বৃদ্ধের মতো। শুধু রয়ে গেছে সেই মঞ্চটা। সারকারিনার শেষ চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে সেটা; আর কিছু নাটকের পোস্টার। উত্তর কলকাতা দেখছে রাতের রাজার নীরব মৃত্যু…    

Powered by Froala Editor

More From Author See More