গাছের ডালে হাজার হাজার ঝুলন্ত পুতুল, ‘পুতুল দ্বীপ’-এর কাছে হার মানে সিনেমাও!

ধীর গতিতে বয়ে চলেছে নীল স্বচ্ছ জলরাশি। আর এই জলপ্রবাহের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি দ্বীপ। সবুজ গাছগাছালিতে ভরা। মানুষ-জনের চিহ্ন নেই কোথাও। দ্বীপ-জুড়ে ছড়িয়ে গুটিকয় পরিত্যক্ত বাড়ি। দূর থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। এমন মনোরম পরিবেশে একান্তে সময় কাটানোর লোভ সামলানো বড়োই কঠিন। তবে এই দ্বীপে পা রাখলেই বদলে যাবে মেজাজ। গা ছমছম করে উঠবে আপনারও। টের পাবেন, নিঃশব্দে আপনার দিকে চেয়ে রয়েছে হাজার হাজার চোখ। 

না, মানুষ নয়। খেলনা পুতুল। তাদের কারোর শরীর বিবস্ত্র, কারোর গায়ে আবার ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক। কারোর চোখ উপড়ে গেছে, তো কারোর বিকৃত হয়ে গেছে গাল। কোথাও আবার ভিজে মাটিতেই ছড়িয়ে রয়েছে পুতুলের বিচ্ছিন্ন হওয়া হাত-পা, মাথা। গাছের ডাল, বাড়ির উঠোন-ছাদ, মাটিতে পুঁতে রাখা লাঠি— সর্বত্রই এহেন পুতুলের ছড়াছড়ি। এ যেন ঠিক কোনো হলিউডি হরর সিনেমার প্লট।

মেক্সিকোর (Mexico) রাজধানী মেক্সিকো সিটি থেকে মাত্র ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই, জোচিমিকো ক্যানালের বুকে হদিশ মিলবে এ-হেন আশ্চর্য এক দুনিয়ার। গা-ছমছমে রহস্যময় এই দ্বীপ সে-দেশে পরিচিত ‘ইসলা দা লাস মিউনিকাস’ নামে। যার অর্থ ‘আইল্যান্ড অফ দ্য ডলস’ (Island Of The Dolls) বা ‘পুতুলের দ্বীপ’। না, কোনো সাজানো স্কেয়ারি হাউস বা সিনেমার সেট নয়। বাস্তবেই মেক্সিকোর ভৌতিক স্থানগুলির মধ্যে নাকি অন্যতম এই দ্বীপ। 

প্রথম থেকেই বলা যাক বিষয়টা। এই ভৌতিক উপকথার জন্ম আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে। তখনও পর্যন্ত এই দ্বীপে নির্ঝঞ্ঝাটে বসবাস করতেন অন্ততপক্ষে হাজার খানেক মানুষ। তবে আকস্মিক একটি দুর্ঘটনাই বদলে দেয় গোটা দ্বীপের ছবি। পুতুল নিয়ে খেলতে খেলতে ক্যানালের জলে পড়ে যায় এই দ্বীপেরই এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কিশোরী। না, চেষ্টা করেও প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়নি তাকে। দ্বীপের ‘কেয়ার-টেকার’ ডন হুলিয়ান সান্তানা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তুলে এনেছিলেন তার নিথর দেহ। এই ঘটনার পর থেকেই শুরু হয় অলৌকিক উপদ্রব। 

হুলিয়ানের দাবি করেন, এক কিশোরী নাকি সারাদিন তাঁর চারপাশে কেঁদে বেড়ায় পুতুলের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনায় মৃত সেই কিশোরীই যে এই কাণ্ডের জন্য দায়ী, তেমনটাই মনে করেছিলেন হুলিয়ান। কিশোরীর অতৃপ্ত আত্মাকে শান্তি দেওয়ার জন্যই দ্বীপের বিভিন্ন গাছে পুতুল টাঙানো শুরু করেন তিনি। গাছে পুতুল টাঙালে অতৃপ্ত আত্মার উৎপাত বন্ধ হবে, এই গুঞ্জন হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে। কাজেই শুধু হুলিয়ানই নন, তাঁর সঙ্গে এই কাজে হাল লাগান গ্রামবাসীরাও। 

তবে উপদ্রব কমা তো দূরের কথা, সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা ঘটে তাতে। এরপর থেকেই গ্রামবাসীদের কানে আসতে শুরু করে ছোট্ট এক কিশোরীর কান্না। পাশাপাশি ঝুলন্ত পুতুলরাও নাকি ইশারায় কাছে ডাকতে শুরু করে গ্রামবাসীদের। স্বাভাবিকভাবেই এরপর থেকে ধীরে ধীরে এই দ্বীপ ছাড়তে থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আশির দশকের শেষে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে জোচিমিকো দ্বীপ। একমাত্র পরিবার হিসাবে সেখানে টিকে ছিল সে-দ্বীপের ‘কেয়ার টেকার’ হুলিয়ানের পরিবার। যাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল এই পুতুল ঝোলানোর রীতি। বলে রাখা প্রয়োজন, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত গোটা দ্বীপজুড়ে পুতুল ঝুলিয়ে গেছেন তিনি। 

উল্লেখ্য, ২০০০ সালে রহস্যজনকভাবে প্রাণ হারান হুলিয়ান। যেখান থেকে তিনি উদ্ধার করেছিলেন সেই ছোট্ট কিশোরীর দেহ, সেখানেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল বৃদ্ধ কেয়ারটেকারকেও। এই ঘটনার পরেই, দ্বীপ ছাড়েন তাঁর আত্মীয়রা। সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত দ্বীপে পরিণত হয় জোচিমিকো। 

মজার বিষয় হল, ১৯৮৭ সালেই এই দ্বীপটিকে ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ইউনেস্কো। তবে সে-সময় আন্তর্জাতিক স্তরে ততটাও পাত্তা পায়নি জোচিমিকো। হুলিয়ানের মৃত্যুর পর এই রহস্যময় দ্বীপের খবর, একাধিক আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ার পর, আন্তর্জাতিক পর্যটক ও ফটোগ্রাফারদের ঢল নামতে শুরু করে জোচিমিকোতে। সেটা ছিল ২০০১ সাল। ‘চায়নাম্পাস’ নামে নতুন পরিচিতিও পায় এই দ্বীপ। জায়গা পায় গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের পাতাতেও। তবে ঠিক কতগুলি পুতুল ঝোলানো রয়েছে এই দ্বীপে, সে-হিসেব নেই কারোর কাছেই। শুধু ঝড়-বৃষ্টি-রোদে পুড়ে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা… 

Powered by Froala Editor