করোনা ভাইরাস এখনও তার শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে জনজীবন। এই অবস্থায় নেট সহ অন্যান্য পরীক্ষা নিয়ে খানিকটা অনিশ্চয়তা ছিলই। তবু একটা বছর পিছিয়ে যাওয়া মানে বহু ছাত্রছাত্রীর জীবন এক বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই হল পরীক্ষা। আর নানা বিষয়ের মধ্যে গতকাল হয়ে গেল বাংলা ভাষার পরীক্ষাও। কিন্তু এখানেই শুরু বিতর্ক। পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে হতবুদ্ধি প্রত্যেকেই। কেন? কয়েকটা প্রশ্ন দেখলেই তার কারণ বোঝা যায়। শিব কোনদিকে তাকিয়ে বিয়ে করেছিলেন - উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব না পশ্চিম? কমেডি নিয়ে অ্যারিস্টটল যা যা আলোচনা করেছেন তার মধ্যে থেকে চার পাঁচটা লাইন ছুঁড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, কোনটা আগে বলেছিলেন, কোনটা পরে? ক্রমানুযায়ী সাজাও।
“এরকম জামাইঠকানো প্রশ্ন একেবারেই অর্থহীন।” প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই বলে ওঠেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ঋতম মুখোপাধ্যায়। “এরকম প্রশ্ন বছরের পর বছর এলে ছাত্রছাত্রীরা কোন ধরনের প্রস্তুতির ভিত্তিতে পরীক্ষায় বসবে?” এমন প্রশ্নও তুলছেন এবারের পরীক্ষার্থী মঞ্জিমা দাশগুপ্ত। এবছর অবশ্য পরীক্ষার পর থেকেই উত্তাল স্যোশাল মিডিয়া। বাংলা ভাষার সঙ্গেই কেন এরকম আচরণ করা হচ্ছে, এই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল. গবেষক অন্বয় গুপ্ত বলছেন, “বছরের পর বছর বাংলা নেট নামক এই সার্কাসে তো এটা নতুন কিছু নয়।” হ্যাঁ, এর আগ প্রতি বছরই এমন অভিযোগ উঠেছে। হয়তো সামাজিক মাধ্যমে সেভাবে দাগ কাটেনি। এমনকি একটি উপন্যাসে কোনো একটি শব্দ কতবার এসেছে, এমন প্রশ্নও এসেছে বলে জানাচ্ছেন অন্বয় গুপ্ত।
এই অভিযোগের উৎস খুঁজতে গেলে অবশ্যই ফিরে তাকাতে হয় নেট পরীক্ষার ইতিহাসের দিকে। “আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকই কিন্তু নেট দিয়ে আসতেন না। তাতে তাঁদের শিক্ষকতার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।” বলছেন ঋতম মুখোপাধ্যায়। “তবে বর্তমানে যেহেতু প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গিয়েছে, তাই একটা ছাঁকনি থাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার প্রশ্নপত্র এমন হওয়া উচিৎ যাতে প্রকৃত যোগ্যতা যাচাই করা যায়। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই সেটা সম্ভব নয়।” এমনটাই মত তাঁর। একটা সময় কিন্তু প্রশ্নপত্র এমন হত না। অন্বয় গুপ্তের কথায়, “অন্তত দশ বছর আগে যাঁরা পাশ করেছেন, তাঁদের টিপ্পনী আমাদের সহ্য করতে হয় কারণ তাঁদের সময় এই ভাঁড়ামোর জায়গায় বড় বড় বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন আসত, দু লাইন লিখে নিজেদের ক্ষমতা অন্তত দেখানো যেত সেখানে।” ঋতম মুখোপাধ্যায়ের মতে, সাহিত্য বোঝার ক্ষেত্রে এই বিশ্লেষণী ক্ষমতাটা অত্যন্ত জরুরি। “তখন অবশ্য পরীক্ষকদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠত। বলা হল যন্ত্রের সাহায্যে খাতা দেখা হলে সেই সমস্যা থাকবে না। কিন্তু যন্ত্র তো শুধুই একজন কতটা তথ্য জানে সেটাই বুঝতে পারে। বিশ্লেষণের ক্ষমতা যাচাই হচ্ছে না।” বলছেন তিনি। তবে কি এমসিকিউ প্রশ্ন করা একেবারেই উচিৎ নয়? না সেটাও বলছেন না তিনি। বলছেন, “এমসিকিউ থাকুক। সঙ্গে সমান পরিমাণে বিশ্লেষণাত্মক প্রশ্নও থাকুক। যেমনটা কিছুদিন আগে পর্যন্ত হত।”
দুই বছরেই পরীক্ষায় বসেছেন অনিন্দিতা দত্ত। তাঁর কথায়, “এবারের প্রশ্ন শুধু অদ্ভুত তাই নয়, অনেক বেশি দীর্ঘ। ওইটুকু সময়ে এত বড় বড় প্রশ্ন পড়ে শেষ করাই সম্ভব নয়।” সব মিলিয়ে যে বাংলা ভাষার নেট পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে সবার মধ্যেই যথেষ্ট সংশয় আছে, সেটা স্পষ্ট। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শুভদীপ সরকার তো বলেই ফেললেন, “এই প্রশ্ন দিয়ে যদি পরোক্ষ ভাবে এটা বোঝাতে চান যে বাংলায় নেট দেবার প্রয়োজন নেই আর তাহলে সেটা সরাসরি বলে দিন৷ বাংলায় নেট তুলে দিন। এটাতে অনেকটা ডিগনিটি বজায় থাকবে৷” পরীক্ষার্থী মঞ্জিমা দাশগুপ্তর মতে, “কলা বিভাগের নানা শাখায় এমনিতেই ফান্ডিং কমিয়ে দিয়েছে ইউজিসি। সেইসঙ্গে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন দেখে মনে হয় যেন গবেষণার ক্ষেত্রটাই তুলে দিতে চায় তারা।” ঋতম মুখোপাধ্যায় যদিও বলছেন, “ইউজিসি কী চায় সেটা নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু বলতে পারি, যাঁরা প্রশ্ন তৈরি করেছেন তাঁরা এই একটাই বাহাদুরি দেখানোর জায়গা পেয়েছেন। বেশ ছাত্রছাত্রীদের জব্দ করা গেল। তবে তাঁরা নিজেরা পরীক্ষায় বসলেও যে একই রকম জব্দ হতেন, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।”
আরও পড়ুন
দুর্বল ইন্টারনেট, তাও অনলাইন পরীক্ষা! আশঙ্কিত বাংলার প্রত্যন্ত এলাকার পড়ুয়ারা
Powered by Froala Editor