ইরানের বুকেই লুকিয়ে একটুকরো পাঞ্জাব 'জাহিদান'!

ইরানের বালুচ সীমান্তের কাছে ছোট্ট একটি শহর জাহিদান। আজ হয়তো সেই শহরের কোনো বিশেষত্ব বোঝার উপায় নেই। তবে শহরের নামের সঙ্গে মিশে রয়েছে এক প্রাচীন ঐতিহ্য। জাহিদান শব্দটি এসেছে পার্সি শব্দ জাহিদ থেকে। যার অর্থ পবিত্র মানুষ। কারা ছিলেন এই পবিত্র মানুষ? আজ থেকে ১০০ বছর আগে ভারত থেকে ইরানে গিয়েছিলেন তাঁরা। না, ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন। প্রত্যেকেই ছিলেন শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ। অথচ ইরানের (Iran) ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে তাঁরাই ছিলেন পবিত্র। আজও জাহিদান (Zahedan) শহরে কয়েকটি শিখ (Sikhs) পরিবার থেকে গিয়েছে। আর থেকে গিয়েছে একটি গুরুদোয়ারা।

পাঞ্জাব থেকে ইরানের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পরেই। বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেলেও পার্সিয়ার ভিতর দিয়ে জার্মান ও অটোমান সামরিক অভিযান চলতেই থাকে। ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করেছিল, ইরান সীমান্ত দিয়ে ঢুকে ভারতেও আক্রমণ চালাতে পারে জার্মান বাহিনী। আর সেই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্যই এক কূটনৈতিক পরিকল্পনা নিলেন তাঁরা। ইরান থেকে কুয়েত পর্যন্ত বসালেন রেললাইন। তারপর সেই খবর ছড়িয়ে দিলেন ভারতের পশ্চিম সীমান্তে। রেললাইন তৈরি হওয়া মানেই সেখানে নানা ধরনের নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা গড়ে ওঠা। আর এই ব্যবসার টানেই ইরান যাওয়ার কথা ভাবলেন অনেকে।

শুধু যে ব্যবসা করাই উদ্দেশ্য ছিল, তা অবশ্য নয়। ইতিমধ্যে পাঞ্জাবে ঘটে গিয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা। ফলে শান্তিপ্রিয় শিখ সম্প্রদায়ের অনেকেই পাঞ্জাব ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন। ইতিমধ্যে আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক শিখ সৈনিক ইরান ঘুরে এসেছেন। সেখানকার মানুষের সঙ্গে মেলামেশাও হয়েছে তাঁদের। যুদ্ধের পর তাঁদের অনেকে পাঞ্জাব থেকে ট্রাকভর্তি ফলমূল ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে ইরানে বিক্রি করে আসতেন। ক্রমশ তাঁরাও ইরানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলেন। আর শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রথম আশ্রয় হয়ে উঠেছিল দোজদাব শহর। এই শহরই পরে জাহিদান নামে পরিচিত হবে।

এরপর ৪০ ও ৫০-এর দশকে তেহরান শহরে ভারতীয়দের বাসস্থান গড়ে উঠতে থাকে। ইরানের আরও বেশ কিছু শহরে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তবে জাহিদান শহরে শিখদের যেন বিদেশি বলে মনেই করতেন না কেউ। শহরের সমস্ত বড়ো বড়ো ব্যবসাই ছিল শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের। হিন্দ-ইরান ব্যাঙ্ক নামে একটি বড়ো ব্যাঙ্কও তৈরি করেছিলেন তাঁরা। তবে এই মেলবন্ধনের ইতিহাস খুব বেশিদিন স্থায়ী হল না।

আরও পড়ুন
কলকাতার বুকে একটুকরো ইরানি হাওয়া, আজও ফারসি ভাষা শেখানো হয় এখানে

রেজা শাহ পাহলভির রাজত্ব পর্যন্ত জাহিদান শহরে শিখরা সসম্মানে ছিলেন। ৭০-এর দশকের শেষদিকে শহরে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। তবে এই সময় থেকেই দেশে ইসলামিক মৌলবাদী উত্থান ঘটতে শুরু করে। ভয় পেয়ে অনেকেই ইরান ছেড়ে ভারতে ফিরে আসেন। কেউ পাড়ি দেন অন্য দেশে। আবার কেউ কেউ ভেবেছিলেন, এতদিনের প্রতিবেশীরা নিশ্চয়ই হঠাৎ শত্রু হয়ে উঠবেন না। তাঁদের সেই বিশ্বাস যে কতটা ভুল ছিল, সেটা বোঝা যায় ১৯৭৮ সালে। সারা দেশজুড়ে ইসলামিক শাসনের দাবিতে যে দাঙ্গা শুরু হয়, তার প্রভাব এসে পড়ে জাহিদান শহরেও। একসময় ভারতের পবিত্র মানুষ হিসাবে যাঁদের দেখেছিলেন ইরানের মানুষ, তাঁরাই হঠাৎ হয়ে উঠলেন বিধর্মী শত্রু। শিখ সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষ গুরুদুয়ারের মধ্যে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন। কারণ প্রত্যেকেই কথা দিয়েছিলেন, গুরুদুয়ারে আক্রমণ করবেন না কেউ।

আরও পড়ুন
ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীকে ‘রিমোট কন্ট্রোলে’ হত্যা! গল্পকেও হার মানায় যে ঘটনা

ধীরে ধীরে পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু পাহলভির রাজত্ব শেষ হয়ে শুরু হয় ইসলামিক মৌলবাদী শাসন। এর মধ্যেও অবশ্য খ্রিস্টান, ইহুদি বা জরাথ্রুস্টীয়রা সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের কোনো স্বীকৃতিই জানায়নি ইরান সরকার। ২০০০ সাল নাগাদ জানা যায় জাহিদান শহরে মাত্র ২০টি শিখ পরিবার রয়েছে। এখন হয়তো সংখ্যাটা আরও কমেছে। স্থানীয় কিছু তথ্য থেকে ১০টি পরিবারের কথা জানা যায়। আর কিছুদিন পর হয়তো তাঁরাও থাকবেন না এই শহরে। হয়তো গুরুদুয়ারটিও একদিন অস্তিত্ব হারাবে। তবে জাহিদান শহরের নামের সঙ্গে থেকে যাবে শিখ সম্প্রদায়ের ইতিহাসও।

আরও পড়ুন
বইয়ের নামে রাস্তার নামকরণ! পথ দেখাচ্ছে ইরান

তথ্যসূত্রঃ
When a small Sikh community thrived in an Iranian border town, Ajay Kamalakaran, Scroll

Powered by Froala Editor