ভারতের মতো ১৪০ কোটি দেশে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম রেল। পরিসংখ্যান বলছে গড়ে ২.২ কোটি ভারতীয় প্রতিদিন যাতায়াত করেন ট্রেনে (Train))। আসলে স্বল্পমূল্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত পৌঁছে যেতে রেলের বিকল্প নেই কোনো। নেই যানজটের আশঙ্কাও। কিন্তু ট্রেনে চেপে মাত্র ৪৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতেই যদি সময় লেগে যায় ৫ ঘণ্টা? চমকে উঠলেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যি। ভারতের বুকেই রয়েছে এমন এক রেলপথ, যেখানে গড়ে ১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগেও ছুটতে পারে না রেলইঞ্জিন।
একদিকে খাদ, অন্যদিকে দেওয়াল তুলেছে সবুজ পাহাড়। দূরে চায়ের বাগানে কাজ করছেন মহিলারা। কোথাও আবার পাহাড়ের কোল বেয়ে গড়িয়ে নামছে ঝর্ণা। নজরকাড়া প্রাকৃতিক দৃশ্য চারদিকে। তার মধ্যে দিয়েই ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলেছে ছোট্ট ট্রেন। তার মাথায় নৃত্যরত শাহরুখ। বছর পঁচিশেক আগের কথা। গোটা দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘ছাঁইয়া ছাঁইয়া’ গানের এই দৃশ্য। হ্যাঁ, ভারতের সবচেয়ে ধীর গতি সম্পন্ন ট্রেন এটিই।
তামিলনাড়ুর নীলগিরি পর্বত (Nilgiri Mountain)। সেখানের মেট্টুপালায়ম এবং উধাগামণ্ডলম— এই দুই শহরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই এই রেলপথ পরিচিত ‘নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে’ নামে। অবশ্য, উধাগামণ্ডলমটির চেয়ে এই উটি নামটিই বেশি পরিচিত আমাদের কাছে। উনিশ শতকে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটানোর জন্যই উধাগামণ্ডলমে ছোট্ট হিলস্টেশন গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশ শাসকরা। ব্রিটিশ ডায়ালেক্টে যার নাম হয়ে যায় ‘ওটাকামুন্ড’। পরবর্তীতে আরও সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘ভারতীয়দের কাছে উটি’ হয়ে এই হিলস্টেশন।
এ তো গেল উটির বৃত্তান্ত। এবার ফিরে আসা যাক এ-দেশের সবচেয়ে ধীর গতি সম্পন্ন ট্রেনের প্রসঙ্গে। ১৮৯১ সাল। উটির যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য বিশেষ রেলপথ তৈরি করা শুরু করে ব্রিটিশ শাসকরা। সে-সময় গোটা ভারত জুড়েই রাজত্ব মার্টিন কোম্পানির। তবে উটিতে যাওয়ার পথ প্রচণ্ড দুর্গম হওয়ায় হাত তুলেছিল তারাও। শেষ পর্যন্ত এই রেলপথ স্থাপনের বায়না পায় একটি সুইস রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং দল।
তবে কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। দীর্ঘ ১৭ বছর সময় লেগেছিল এই পথ তৈরিতে। মাত্র ৪৬ কিলোমিটারে রেলপথ তৈরি করতে বানাতে হয়েছিল ১৬টি টানেল, ২৫০টি সেতু। সেইসঙ্গে পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো হয়েছিল ২০৮টি অর্থচন্দ্রাকৃতি পথ। যা যথেষ্ট চড়াইও বটে। তাতে রেল চলাচলের যোগ্য পথ তৈরি হলেও, প্রাকৃতিক এই প্রতিকূলতার কারণে দ্রুত গতিতে ট্রেন চালানোই দায় হয়ে ওঠে। অবশ্য গ্রীষ্মের অবসর কাটাতে যাওয়া মানুষদেরকে এই দীর্ঘ রেলযাত্রা ভাবায়নি কোনোদিনই।
ভারতের অন্যান্য প্রায় সমস্ত জায়গাতেই ন্যারো গেজের রেলপথ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, শেষ প্রদীপ হয়ে জেগে রয়েছে দার্জিলিং এবং উটির এই রেল। ‘নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে’-খ্যাত এই রেলপথের বয়স হয়েছে ১১৫ বছর। তবে টিকিটের দাম ছাড়া, দীর্ঘ এক শতাব্দীর বেশি সময়েও তাতে বদল আসেনি কোনো। নগরায়ন কিংবা উন্নয়ন উটির চেহারা বদলে দিলেও, আজও অপরিবর্তিত রয়েছে এই রেলপথ, তার দু’পাশের অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এমনকি বছর কয়েক আগে এই রেলপথকে ঐতিহ্যবাহী স্থান অর্থাৎ হেরিটেজ সাইটের তকমাও দেয় ইউনেস্কো। সবমিলিয়ে ‘ধীরতম এই রেলপথ’ কুখ্যাতি নয়, বরং গর্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা দেশের কাছেই…
Powered by Froala Editor