টাইটানিক (Titanic) জাহাজডুবির গল্প প্রায় সবাই জানে। জাহাজ কোম্পানির দাবি ছিল টাইটানিক ‘আনসিঙ্কেবল’। অর্থাৎ ঝড়-তুফান যাই আসুক না কেন, কোনোভাবেই ডুববে না জাহাজটি। কিন্তু ভবিতব্যকে এড়াতে পারেনি সে। ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আতলান্তিক মহাসাগরে সলিলসমাধি ঘটে জাহাজটি। মারা যান প্রায় ১৫০০ মানুষ। তার ঠিক ৪৭ বছর পরের কথা। একইভাবে একটি ‘আনসিঙ্কেবল’ জাহাজ ভেসে পড়ে সমুদ্রে। মৃত্যুর করাল ছায়া সমুদ্রগর্ভে কোথায় যে ওঁৎ পেতে বসেছিল টের পায়নি কেউই। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে হিমশৈলের ধাক্কায় টাইটানিকের মতো পরিণতি হয় জাহাজটির। খুঁজে পাওয়া যায়নি একজন যাত্রীরও দেহ।
জাহাজটির নাম এমএস হান্স হেডটফট (MS Hans Hedtoft)। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত ডেনমার্কের (Denmark) জাহাজটি তখন ছিল গর্বের সামগ্রী। যাকে বলা হত গ্রিনল্যান্ডের সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ জাহাজ। উত্তর ডেনমার্কের ফ্রেডরিকশাভন অঞ্চলে বানানো হয় ২৭১ ফুট দৈর্ঘের জাহাজটি। ওজন ছিল প্রায় ৩০০০ টন। প্রস্তুতকারক সংস্থাটিকে ডেনমার্কের সরকার বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছিল যাতে সুমেরু সাগরের উত্তরদিকের দুর্গম আবহাওয়াতেও নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারে হান্স। সেভাবেই তৈরি করা হয় সেটিকে। শক্ত ধাতব চাদরে মুড়ে দেওয়া হয় গোটা শরীর। হিমশৈলে ধাক্কা লাগলেও কোনো ক্ষতি হবে না জাহাজের। আমূল পালটে ফেলা হয় দিকনির্ণয় যন্ত্রের কার্যকারিতা। জাহাজের ক্যাপ্টেন পি. এল. রাসমুসেনের মতে এই ব্যবস্থা ‘বিপ্লব’ আনতে পারে দিকনির্ণয়ের কাজে। সরকার পক্ষের বিবৃতিতে জানানো হয় যে, গ্রিনল্যান্ডের উপকূলবর্তী অঞ্চলে সারাবছর ঘুরে বেড়ানোর জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত আর কিছু হতে পারে না। অবশ্য সন্দেহ প্রকাশ করার লোক যে ছিল না, তা নয়। প্রযুক্তিগত সমস্ত ব্যবস্থা যে সুনিপুণ হয়নি, সেটা অনেকেই প্রমাণ করেছিলেন যুক্তি দিয়ে। এই অবস্থায় সুমেরু সাগরে ভেসে পড়াটা ঠিক হবে না, এটাই ছিল তাদের মত। কিন্তু ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া হল সমস্ত যুক্তি।
অবশেষে ১৯৫৯ সালের ৭ জানুয়ারি কোপেনহাগেন থেকে গ্রিনল্যান্ডের দিকে রওনা দিল হান্স হেডটফট। দুর্জনের মুখে ছাই দিয়ে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার পথ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পাড়ি দিয়ে পৌঁছোয় গ্রিনল্যান্ডের কোয়াকোরটোকে। না, রাস্তায় কোনো বিপদ হয়নি। শুধু প্রাকৃতিক নয়, অন্য কোনো বিপদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ডেনমার্কের প্রতিরক্ষা বিভাগ জাহাজে বসিয়েছিল তিনটি অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান। এরপর রাজধানী নুক, সিসিমুট ও মানিসটোক ঘুরে এবার ঘরে ফেরার পালা। ২৯ জানুয়ারি ৯৫ জন যাত্রীসহ কোপেনহাগেনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় হান্স। এদের মধ্যে ৪০ জন জাহাজের কর্মচারী, বাকিরা সাধারণ যাত্রী। ডেনমার্কের পার্লামেন্টে গ্রিনল্যান্ডের দুজন প্রতিনিধি ও তাদের পরিবারও ফেরার পথে সামিল হয়েছেন এই ‘নিরাপদ’ যাত্রায়। এছাড়াও আছে প্রচুর ধরনের পণ্য।
পরদিন, অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি সকালেই এক ভয়ানক ঝড়ের মুখোমুখি হয় হান্স। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে, কাজ করছে না দিকনির্ণয় যন্ত্র। অকূল সমুদ্র আছড়ে পড়ছে জাহাজের পাটাতনে। দুপুর দুটো নাগাদ গ্রিনল্যান্ডের দপ্তরে হান্স থেকে এসে পৌঁছোয় একটি জরুরিবার্তা। হিমশৈলে ধাক্কা খেয়েছে হান্স। ভেঙে গেছে শক্ত ধাতব চাদর। দ্রুতগতিতে জল ঢুকে পড়ছে ইঞ্জিনঘরে। অবিলম্বে সাহায্য না এলে মৃত্যু অনিবার্য। দুপুর তিনটে বারো। ক্রমশ জলে ডুবে যাচ্ছে হান্স। আশেপাশে থাকা কয়েকটি জাহাজ মুখ ঘুরিয়ে রওনা দিল তার দিকে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সন্ধে পাঁচটা একচল্লিশ। গ্রিনল্যান্ড থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূর থেকে শেষ বার্তা এল হান্সের থেকে। তারপর সব নিশ্চুপ, নিথর।
আরও পড়ুন
নদীর দু-ধার ঘেঁষে জাহাজের ‘সমাধিক্ষেত্র’
পরবর্তী কদিন খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও লাগাতার তল্লাশি চালানো হয় তার জন্য। ৯৫ জন মানুষের কারোর সন্ধান মেলেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, জাহাজটিতে তিনটি লাইফবোট ছিল, যার প্রত্যেকটিতে ৩৫ জন করে যাত্রী উঠতে পারত অনায়াসে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে খোলা হয়নি একটি লাইফবোটও। কী আশা করেছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন? সাহায্য চলে আসবে? নাকি দুর্যোগের মধ্যে লাইফবোটে ভেসে পড়াটাও সমান বিপজ্জনক? উত্তর মিলবে না আর কোনোদিন। ডুবে যায় হান্স। ঘটনার ঘনঘটায় কিংবা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণে টাইটানিকের মতো না হলেও, অমোঘ নিয়তি মিলিয়ে দিয়েছে দুটিকে। হিমশৈলে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যাওয়া পৃথিবীর শেষতম জাহাজ হিসেবে নাম ওঠে হান্স হেডটফটের।
আরও পড়ুন
সমুদ্রের অতলে লুকিয়ে আড়াই হাজার বছরের ‘সংরক্ষিত’ জাহাজ, বদলে যেতে পারে ইতিহাসের ধারা
Powered by Froala Editor