কোথাও হাত খানেক, হাত দেড়েক প্রশস্ত গলি, কোথাও আবার কানাগলি— সে পথ ধরে খানিক দূর অবধি যাওয়া গেলেও গন্তব্য নেই কোনো। উত্তর কলকাতাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এমনই আশ্চর্য সব গলিগলতা। তবে মজার বিষয় হল, এতকিছুর পরেও বিশ্বের ক্ষুদ্রতম রাস্তা হিসাবে গিনেস বুকের পাতায় নাম তুলতে পারেনি উত্তর কলকাতা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, তবে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম রাস্তা কোনটি? কোথায়-ই বা রয়েছে এই আশ্চর্য পথ?
স্কটল্যান্ডের (Scotland) উইক শহর। তিন-মাথার মোড়ে অবস্থিত প্রকাণ্ড এক ত্রিকোণাকার বাড়ি। না, বাড়ি বলা ঠিক হবে না, এই প্রকাণ্ড ভবন আদতে একটি বিলাসবহুল হোটেল। আর তার দু’দিক থেকেই চলে গেলে লম্বা দুটি রাস্তা। ‘ম্যাকে’স হোটেল’ (Mackay's Hotel)। স্কটল্যান্ডের এই হোটেলে বিলাসবহুল জীবনের স্বাদ নিয়ে প্রতিদিনই হাজির হন শত শত মানুষ। তাছাড়া এই হোটেলে ভিড় জমানোর আরও একটি কারণ রয়েছে পর্যটকদের। আর তা হল, বিশ্বের ক্ষুদ্রতম রাস্তা।
ছবি দেখে ভ্রূকুঞ্চিত হল, নিশ্চয়ই? হোটেলের দু’দিক দিয়েই যে পিচ বাঁধানো পাকা লম্বা রাস্তা চলে গেছে সোজা। তবে ক্ষুদ্রতম রাস্তা আসছে কোথা থেকে? এই ধাঁধাঁর সমাধান রয়েছে ‘ম্যাকে’স হোটেল’-এর ঠিকানায়— ১ ইবনিজার প্লেস (Ebenezer Place)। সাধারণত, কোনো বিশেষ রাস্তার ওপর অবস্থিত বাড়িগুলির ঠিকানা নির্ধারণ করা হয়, ওই রাস্তার নামের আগে ক্রমানুক্রমিক সংখ্যা দিয়ে। অর্থাৎ, যে বাড়িটি রাস্তার ঠিক শুরুতেই রয়েছে তার ক্রমিক সংখ্যা ‘১’, দ্বিতীয়টির ‘২’— এভাবেই চলছে থাকে নামকরণের প্রক্রিয়া। কখনও আবার গলি, উপগলি থাকলে ব্যবহার করা হয় ‘বাই’ বা ‘/’ চিহ্ন। অবশ্য ‘ম্যাকে’স হোটেল’-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। ইবনিজার প্লেস রাস্তা ধরে ঠিকানা খুঁজলে কেবলমাত্র একটিমাত্র বাড়িরই সন্ধান মিলবে। আর সেটিই ‘ম্যাকে’স হোটেল’।
আসলে, এই হোটেলের দু’দিক দিয়ে যে বড়ো রাস্তা দুটি চলে গেছে, সেগুলির নাম যথাক্রমে রিভার স্ট্রিট এবং ইউনিয়ন স্ট্রিট। আর এই দুই রাস্তার সংযোগস্থানেই তৈরি হয় ছোট্ট একটি ব-দ্বীপের মতো অঞ্চল। মাত্র ২ মিটার অর্থাৎ ৬ ফুট লম্বা এই অংশটির নামই ইবনিজার স্ট্রিট বা ইবনিজার প্লেস। কিন্তু ছোট্ট এই পথকে পৃথক রাস্তার আখ্যা দেওয়া হল কেন?
ফিরে যেতে হবে একশো চল্লিশ বছর আগে। ১৮৮৩ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর স্কটল্যান্ডের এই অঞ্চলে হোটেল নির্মাণ করেন ব্রিটিশ উদ্যোগপতি আলেকজান্ডার সিনক্লেয়ার। হোটেলের দুই প্রান্তের রাস্তা ইউনিয়ন স্ট্রিট এবং রিভার স্ট্রিট দু’দিকেই হোটেলের প্রবেশপথ নির্মিত হয়েছিল। তবে তাতে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না সিনক্লেয়ার। বরং, এই হোটেলকে বাকিদের থেকে পৃথক করে তুলতে দুই রাস্তার সংযোগস্থলে মূল প্রবেশপথ নির্মাণ করেন তিনি। সিটি কাউন্সিলের কাছে আবেদন করেন এই নির্দিষ্ট প্রবেশপথটিকে কেন্দ্র করেই ঠিকানা দিতে হবে ভবনটির। সিনক্লেয়ারের কথাকে মান্য দিয়েই স্কটিশ সিটি কাউন্সিল দুই রাস্তার সংযোগস্থলে ২ মিটার প্রশস্ত অঞ্চলটির নাম রাখে ইবনিজার প্লেস। পরবর্তীতে এই রাস্তাই হয়ে ওঠে ‘ম্যাকে’স হোটেল’-এর অন্যতম জনপ্রিয়তার কারণ। এমনকি এই হোটেলের কথা উল্লেখিত হয়েছে উনিশ ও বিশ শতকের একাধিক সাহিত্যেও।
২০০৬ সালে এই ছোট্ট অংশটিকে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম রাস্তার তকমা দেয় গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসও। এমনকি সংশ্লিষ্ট হোটেলের ওয়েবসাইটে গেলেও উল্লেখিত রয়েছে এ-কথার। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, এই অভিনব বৈশিষ্টই যেন বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়িয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানের…
Powered by Froala Editor