পশ্চিমঘাটে অরণ্যের রক্ষাকর্তা ‘সর্পদেবতা’, উন্নয়নের কোপে হারাতে বসেছে তারাই!

নির্জন অরণ্য। তার মধ্যেই ছোট্ট একটি মন্দির। অবশ্য মন্দির বলা ভুল হবে। গাছগাছালি ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে বেদী। সেখাই প্রতিষ্ঠিত পাথরের দেবতা। সেখানেই আসেন স্থানীয় ভক্তরা। ধরুন আপনিও হাজির হয়েছেন সেখানে। আর চোখ বুজিয়ে প্রার্থনা করার সময়ই অনুভব করলেন পায়ে ঠান্ডা এক স্পর্শ। বুক ঘষে চলে যাচ্ছে বিষধর একটা সাপ। চমকে উঠবেন কি? চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় দ্রুত আত্মরক্ষার জন্য তুলে নিতে পারেন লাঠি বা পাথরও। তবে স্থানীয়রা এমন ঘটনার সাক্ষী হলে, নিজেদের ভাগ্যবান বলেই মনে করেন। মারা তো দূরের কথা, বরং নির্বিঘ্নে তাকে চলে যাওয়ার জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন মিনিট খানেক।

কেরল, কর্ণাটক বা তামিলনাড়ুতে গেলে হামেশাই দেখা মিলবে এমন দৃশ্যের। চিরসবুজ অরণ্যে মোড়া পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। আর সেখানেই ছড়িয়ে রয়েছে এমন অজস্র মন্দির। তবে এই অরণ্যগুলি বনবিভাগের চিহ্নিত অরণ্য নয়। কখনো ব্যক্তিগত জমিতে, কখনো বা সরকারি জমিতেই গজিয়ে ওঠা ঘন উপবনের মধ্যে হদিশ মিলবে এই ধরণের মন্দিরের। মানুষের নিত্যদিনের আনাগোনা এবং বড় কোনো শিকারি প্রাণী না থাকায় যেখানে নিশ্চিন্তেই সংসার পদহীন বিষধর এই সরীসৃপদের। তবে স্থানীয় মানুষদের কাছে তারা কেবলই প্রাণী নয়, তারাই স্বয়ং ঈশ্বর।

পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় এই সরীসৃপরাই পূজিত হন সর্পদেবতা হিসাবে। লোক-সংস্কৃতিতে এভাবেই মিশে গেছে তাদের অস্তিত্ব। আর এই ধরণের উপবন, তার মধ্যে থাকা মজে যাওয়া পুকুর, ঝর্ণা কিংবা প্রাচীন কোনো কুয়োও তাঁদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। স্থানীয় ভাষায় এই স্নেক-গার্ডেনের নাম সর্পকাভু।

সর্পকাভুর ছোটো ছোটো এই মন্দিরগুলিতে মূর্তি মূলত পাথরের। কখনও তা কেবলই আকৃতিহীন। আবার কখনও তাতে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে সাপের অবয়ব। নিয়ম করেই তাতে চড়ে হলুদ, দুধ আর জলের প্রলেপ। জ্বালানো হয় ধূপ-মোমবাতি। ভক্তরা সাজিয়ে যান ফুলের মালায়। আর জীবন্ত দেবতাদের জন্য বাটিতে রেখে যান দুধ ও জলের মিশ্রণ। হামেশাই সেখানে দেখা দেন ভগবান। কেউটে, গোখরো, বা শাঁখামুটিদের দেখতে পেলে প্রণামও করেন স্থানীয়তা। প্রকৃতির সঙ্গে, প্রাণীজগতের সঙ্গে এভাবেই যেন আত্মীয়তায় বেঁধে রয়েছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
জাপানের এই মন্দিরে দেবতা থেকে পুরোহিত সবাই বিড়াল

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে পবিত্র এই উপবনগুলিতে যাওয়া ৯৬ শতাংশ মানুষই বিপদের সম্মুখীন হলেও আঘাত করতে চান না সাপেদের। তবে ওই অঞ্চলেই লোকালয়ে ওই একই সমীক্ষায় ফলাফল এসেছিল মাত্র ৬৬ শতাংশ। সমীক্ষার তথ্য থেকেই সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে আসে, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং লোকসংস্কৃতির সৌজন্যেই পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় দিব্যি টিকে রয়েছে বাস্তুতন্ত্র। 

তবে শুধুই কি সাপেদেরই নিরাপত্তা প্রদান করে এই ধর্মীয় আচার? তা একাবারেই নয়। হার্বেরিয়ামের জন্য এই জঙ্গলের পাতা সংগ্রহ করতে যাওয়াতেও স্থানীয়দের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল কেরালা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পালাট্টি সিনুকে। কারণ? স্থানীয়দের অভিমত, জঙ্গলের পোকা-মাকড় এবং ছোট জীবজন্তুদের খেয়েই বেঁচে থাকেন সর্পদেবতারা। আর সেইসব পোকা-মাকড়দের জীবন নির্ভরশীল গাছের ওপরেই। ফলে পবিত্র এই উপবনের কোনোরকম ক্ষতিসাধনই অপরাধযোগ্য। কাজেই শুধু সর্পদেবতা নয় বরং পুরো বাস্তুতন্ত্রেরই নিয়ামক হয়ে গেছে লোকসংস্কৃতি।

আরও পড়ুন
গতজন্মে ছিলেন মিশরের পুরোহিত, দেখা পেয়েছেন দেবতারও – এক মহিলা ‘জাতিস্মর’-এর কাহিনি

কিন্তু তারপরেও দিন দিন কমে চলেছে এই ধরণের উপবনের সংখ্যা। কেরালার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৫৬ সালে কেরালার পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় এই ধরণের অরণ্যের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। যা কমতে কমতে আজ এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২০০–তে। যার পিছনের রয়েছে সভ্যতারই হস্তক্ষেপ। ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত এই ধরণের জমিগুলির ক্ষেত্রে এখন অধিকাংশ স্থানেই গজিয়ে উঠছে মাল্টিপ্লেক্স। হচ্ছে কমপ্লেক্স, সুপার মার্কেট। কোথাও বা জঙ্গল কেটে মানুষ বিক্রি করছেন লক্ষ লক্ষ টাকার দামি কাঠ। প্রকল্পগুলির সঙ্গে বড়ো বড়ো বহুজাতিক সংস্থার নাম জড়িয়ে থাকায়, কোনোভাবেই দানা বাঁধতে পারছে না স্থানীয়দের বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ। 

অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছেও ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে এই প্রাচীনপন্থী বিশ্বাস। সাপকে দেবতাজ্ঞানে পূজার্চনা একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে অনেকের কাছেই স্রেফ বোকামি। আবার কোথাও বাণিজ্যিক লাভের কথা ভেবেই ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে সর্পকাভুর এই ধরণের বেদীগুলি। তার বদলে লোকালয়ের মধ্যেই তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে কংক্রিটের মন্দির। উপায় না পেয়ে সেখানেই পুজো দিচ্ছেন স্থানীয়রা। লাভবান হচ্ছেন মন্দিরের মালিক। তবে এসবের পিছনেই কোথাও ধীরে ধীরে নিরাপত্তা হারাচ্ছে বন্যেরা। শেষ হচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন এক ঐতিহ্য। মানুষের সঙ্গে অরণ্যের সম্পর্ক। 

আরও পড়ুন
টেনশন কমাতে চান? হাজির কোচবিহারের নয়া দেবতা ‘টেনশন ঠাকুর’

তবুও এই অরণ্য, বাস্তুতন্ত্র, জীব-বৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করে চলেছেন অনেকে। ২০০২ সালে রামাচন্দ্র নামে কেরালার এক ব্যক্তি কেরালা ও কর্ণাটকের বনদপ্তরের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন এই ধরণের পবিত্র উপবনগুলির ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করার জন্য। দাবি জানিয়েছিলেন যাতে এই ধরণের উপবনগুলিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে সংরক্ষিত করা হয়। তবে সেই আবেদনে সাড়া মেলেনি এখনও। অক্লান্তভাবেই এখনও তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচেষ্টা। পাশাপাশি এমন আরও উদ্যোগ নিয়েছেন অনেকে। কেউ ব্যক্তিগতভাবেই বৃক্ষরোপণ করে গড়ে তুলতে চাইছেন হারিয়ে যাওয়া পবিত্র উপবন। আবার কেউ অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে সচেতন করতে চাইছেন মানুষকে। সেই অ্যাপের মাধ্যমেই পরিচয় করাচ্ছেন বিভিন্ন প্রজাতির সাপের সঙ্গে। দেখাচ্ছেন সর্পদংশনের প্রতিকারের উপায়, হাসপাতালের ঠিকানা সমস্ত কিছুই। বিষধর সাপ মানেই যে মৃত্যু, আতঙ্ক নয়। সেই ধারণারই বীজ বপন করে দিতে চাইছেন তিনি। এভাবেই পরিবেশ বাঁচানোর এক যুদ্ধ চলছে পশ্চিমঘাটে। আর সেই যুদ্ধে অজান্তেই সামিল হয়ে গেছে ধর্মীয় বিশ্বাস, লোকাচার...

ঋণ ও তথ্যসূত্র - Cultural beliefs protect snakes in the dwindling sacred groves of southwestern India, Neha Jain, Mongabay

Powered by Froala Editor

More From Author See More