১৯৭৭ সাল সেটা। ঘড়ির কাঁটায় তখন ১০টা। কেউ ব্রেকফাস্ট সারছেন, আবার কেউ বাজারে বেরিয়েছেন কিংবা মাঠে যাচ্ছেন কৃষিকাজে। এমন সময়ই হঠাৎ গর্জন করে উঠল কামান। দুর্গ থেকে বেজে উঠল এক ভিন্ন জাতীয় সঙ্গীত। যা সম্পূর্ণ অপরিচিত স্থানীয়দের কাছে। আকাশে উড়ল পতাকা। সেই সঙ্গে মুকুট পরে, হাতে পিতলের রাজদণ্ড নিয়ে পথে নামলেন এক ব্যক্তি। না, এই ব্যক্তি অবশ্য স্থানীয়দের কাছে অপরিচিত নন। ১৯৩৮ সালে এই ছোট্ট শহরেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা তাঁর। শহরের প্রথম বই-এর দোকানটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই।
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে এমনই অদ্ভুত এক দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিল ব্রিটেন তথা ওয়েলসের ছোট্ট শহর হে (Hay)। হে-অন-ওয়াই-এর রাস্তায় এক অদ্ভুত মিছিল করে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের কথা ঘোষণা করেছিলেন সেখানকার বই ব্যবসায়ী রিচার্ড বুথ (Richard Booth)। আর তাঁর এই উদ্যোগে সাড়া পড়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। এ কি করে হয়? তবে কি ব্রিটেনের (Britain) অভ্যন্তরেও দানা বাঁধল বিচ্ছিন্নতাবাদ?
না, তা নয়। আসলে ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল পয়লা এপ্রিল। এপ্রিল দিবসের দিনেই এই অদ্ভুত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রিচার্ড। তবে মানুষকে বোকা বানিয়ে গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, স্বতন্ত্রতার বার্তা পৌঁছে দেওয়া লন্ডনের শাসকদের কাছে। ছোট্ট এই শহরের উন্নয়নের দাবিতেই, এমন এক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি।
আদতে হে শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বাদশ শতকে। নরম্যান-শাসকদের রাজত্বের কেন্দ্র ছিল এই ছোট্ট শহরটি। তবে সেই রাজত্বের অবসানের পর থেকে ধীরে ধীরে অতলে তলিয়ে যায় হে। বদলে লন্ডন হয়ে ওঠে যুক্তরাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। অন্যদিকে আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে অবস্থিত এই ছোট্ট নগরী ধীরে ধীরে হারায় তার জনপ্রিয়তা। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেখানকার জনসংখ্যা এসে ঠেকে মাত্র হাজার খানেকে। তাও অধিকাংশ মানুষই শিক্ষালাভের পর চাকরির জন্য পাড়ি দিতেন লন্ডনে।
রিচার্ডের পরিবারও ছোট্ট এই শহর থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিল লন্ডনে। রিচার্ডকেও পড়াশোনার জন্য বেশ কিছুদিন কাটাতে হয় ব্রিটেনের রাজধানীতে। তবে সেখানে না থেকে তিনি ফিরে আসেন জন্মভূমিতে। ১৯৬২ সালে হে-এর একটি পরিত্যক্ত দমকল-কেন্দ্র কিনে নিয়ে সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেন হে-এর প্রথম বই-এর দোকান। তার আগে পর্যন্ত বই কিনতে হলে সকলকেই হাজির হতে হত লন্ডন কিংবা আয়ারল্যান্ডের বড়ো শহরগুলিতে। ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর বই-দোকান। তবে নতুন বই নয়, রিচার্ড ব্যবসা করতেন কেবলমাত্র পুরনো বই-এর। লক্ষ্য ছিল, স্বল্পমূল্যে পাঠকদের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া।
বলাই বাহুল্য একশো শতাংশ সফল হয়েছিল তাঁর এই উদ্যোগ। যে-শহরে পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই-এর চল ছিল না, সেখানেই সাহিত্যচর্চার অভ্যাস গড়ে তোলেন রিচার্ড। লাভও মন্দ ছিল না। ফলে, ১৯৬৪ সালে ঐতিহ্যবাহী হে-ক্যাসেলটিরও মালিকানা নিজের দখলে আনেন তিনি। এর বছর ছয়েক বাদে কিনে নেন সেখানকার পরিত্যক্ত কৃষিভবনও। সেখানেই গড়ে তোলেন এক প্রকাণ্ড বই-এর দোকান। আজও যা টিকে রয়েছে ‘রিচার্ড বুথ’স বুকশপ’ হিসাবে।
তবে শুধু নিজের ব্যবসাকেই দিনে দিনে বাড়াননি রিচার্ড। বরং, স্থানীয়দেরও সামিল করেছিলেন বই-এর ব্যবসায়। আজ ছোট্ট এই শহরে বসবাস ১৫০০ জনের, অথচ সেখানেই রয়েছে ২০টির বেশ পুরনো বই-এর দোকান। কিন্তু ক্রমশ দোকানের আধিক্য বাড়তে থাকায়, ক্রেতার সংখ্যায় টান পড়ে প্রত্যেকেরই। এই সমস্যার সমাধানেই অভিনব এক পন্থা খোঁজেন রিচার্ড। তিনি ভালোই বুঝেছিলেন, এতগুলো মানুষের ব্যবসা বাঁচাতে গেলে বাইরের পাঠকদের নিয়ে আসতে হবে এই শহরে। কিন্তু দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় তা খুব একটা সহজ নয়। গোটা বিশ্বের নজর কাড়তেই তাই ছোট্ট শহরটিকে স্বাধীন দেশ হিসাবে ঘোষণা করেন তিনি। শুধু তাই নয়, নিজের ঘোড়াকে হে-শহরের প্রধানমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেন। একদিনের মধ্যেই গড়ে তোলেন আস্ত এক মন্ত্রিসভা। নতুন পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, মুদ্রা, স্ট্যাম্পও প্রকাশ করেন রিচার্ড।
রিচার্ডের এই পদক্ষেপ রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় গোটা বিশ্বজুড়েই। নড়েচড়ে বসে লন্ডনের শাসকরাও। আর এই ঘটনার বছর খানেকের মধ্যেই রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হে। বাড়ে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সংখ্যা। ঠেলায় পড়ে শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে বড়ো অঙ্কের বিনিয়োগও করে ব্রিটিশ সরকার।
তবে এই গল্পের এখানেই শেষ নয়। ১৯৭৮ সালে, রিচার্ডের দোকান স্বীকৃতি পায় গিনেস বুক অফ ওয়ার্ড রেকর্ডের। তৎকালীন সময়ে ১০ লক্ষেরও বেশি পুরনো বই-এর সম্ভার ছিল সেই দোকানে। আজও বিশ্বের বৃহত্তম সেকেন্ড হ্যান্ড বই-এর দোকান এটিই। তবে সেখানে বই-এর সংখ্যা বেড়ে কয়েকগুণ। তাছাড়াও ওয়েলস ট্যুরিজম বোর্ডের থেকে ‘টাউন অফ বুক’ তকমাও পেয়েছে এই ছোট্ট শহরটি।
১৯৮৮ সালে রিচার্ডের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল একটি বিশেষ উৎসব। হে-ফেস্টিভাল নামে পরিচিত এই উৎসবই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড়ো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুধুমাত্র পুরনো বই-ই বিক্রি হয় এই উৎসবে। সেইসঙ্গে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা লেখক-লেখিকারা।
২০১৯ সালে মৃত্যু হয় রিচার্ডের। তার আগে পর্যন্ত স্ব-ঘোষিত এই বই-রাজ্যের রাজার মুকুট মাথায় পরেছেন তিনি। স্থানীয়দের কাছে হয়ে উঠেছিল ঈশ্বরসম। বলতে গেলে, তাঁর উদ্যোগেই বদলে গিয়েছিল গোটা শহরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ছবি। মাস খানেক আগে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত হে-মন্ত্রিসভার উদ্যোগে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় হে-ক্যাসেল-এর দরজা। বিগত ৯০০ বছরে এই প্রথম হে-ক্যাসেলে পা পড়তে চলেছে সাধারণ মানুষের। আদতে এই দুর্গটি রিচার্ড কিনেছিলেন আরও একটি বই-এর দোকান তৈরির জন্য। তবে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ার আশঙ্কায় আর সে-পথে হাঁটেননি তিনি। বরং, পরিত্যক্ত অবস্থাতেই তা পড়েছিল এতদিন। এবার প্রাচীন এই দুর্গটিই হয়ে উঠেছে হে শহরের একমাত্র মিউজিয়াম। ধরে রখেছে তাঁর অদ্ভুত এই সংগ্রাম, ইতিহাসকে…
Powered by Froala Editor