সাত বছর ধরে তৈরি হল ভাস্কর্য, অমরত্ব পেলেন শিল্পী

বিভূতিভূষণের 'মেঘ-মল্লার' গল্পে প্রদ্যুম্নকে মনে পড়ে? সেই প্রদ্যুম্ন, যে দেবী সরস্বতীকে মুক্তি দিতে গিয়ে নিজে পাথর হয়ে গেছিল? গ্রেকোরোমান শৈলির ভাস্কর্যগুলিকে দেখলেও মাঝে মাঝে মনে হয় - এক অপার্থিব মায়া তাদের জড়িয়ে রেখেছে! তাদের শরীরী ভাষা মোহাচ্ছন্ন করে। মনে হয় শাপভ্রষ্ট, আটকে আছে এই পাথরের মধ্যে। যেন হঠাৎ কোনো মুহূর্তে পাথরে পরিণত হয়েছিল বহু শতাব্দী আগে; হঠাৎই কোনো কিছুর স্পর্শে হয়ত সেভাবেই আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে!

একবার ইউরোপীয় নবজাগরণের এমনই এক বিস্ময়কর নিদর্শনের ছবি চোখে পড়েছিল। এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি নিয়ে একজন মৎস্যজীবী নিজেরই জালে আটকে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর স্মিতহাস্যময় এক বালক সেই জাল সরিয়ে তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। বালক সাধারণ নয়, তার পিঠে ডানা, মাথায় শিরস্ত্রাণ – দেবদূত। জানলাম সেই ভাস্কর্যের নাম 'Il Disinganno'(ইল দিসিনগানো) বা 'The Release from Deception'(দ্য রিলিজ ফ্রম ডিসেপশন)। চ্যাপেলা সানসেভেরো নামে ইতালিতে অবস্থিত এক গির্জার সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত এই নিদর্শন... শিল্পের বিস্ময়। একের পর এক ছবি, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে নেওয়া পর পর রাখা ছিল... চোখ ফেরানো যায় না। 


এই চ্যাপেলটি আসলে একটি ভাস্কর্যের সংগ্রহশালায় পরিণত হয়ে গেছে; এবং একই সঙ্গে পরিণত হয়েছে কিংবদন্তী ইতালিয় নবজাগরণের শৈল্পিক নিদর্শনের দ্রষ্টব্য সৌধ হিসেবে। পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে আসা পর্যটক, তাত্ত্বিক, গবেষক, তথ্যচিত্র নির্মাতাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই চ্যাপেলে সংরক্ষিত আছে প্রায় ত্রিশটির মত মার্বেল-পাথরের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যগুলির বিশেষত্ব হল, এরা প্রত্যেকেই অ্যালিগোরিকাল। মানে রূপক, অথবা প্রতীক। এদের অন্তর্নিহিত অর্থ, অথবা বাইবেলের কোনো দর্শন বা ঘটনার সঙ্গে এদের সম্পর্ক অনুধাবন এবং গবেষণার বিষয়। 

এই শৃঙ্খলার ভাস্কর্যগুলির মধ্যে, বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য তিনটি মাস্টার পিস্‌ হল - 
শিল্পী অ্যান্তোনিও কোরাদিনির ভাস্কর্য 'দ্য ভেইল্ড ট্রুথ'
শিল্পী জিসেপ্পে সানমার্তিনোর 'দ্য ভেইল্ড ক্রাইস্ট'
এবং শিল্পী ফ্রানচেস্কো কুয়েরোলোর ভাস্কর্য 'ইল দিসিনগানো' বা 'দ্য রিলিজ ফ্রম ডিসেপশন' 

বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন, কেবল একটি মার্বেল পাথরের বৃহৎ খণ্ড থেকেই এই ভাস্কর্য নির্মিত।

এই ইল দিসিনগানো (Il Disinganno) বা ভ্রম-মুক্তি (The Release from Deception) নামক বিখ্যাত ভাস্কর্যটি সৃষ্টি করেছিলেন জেনোয়ার শিল্পী ভাস্কর ফ্রানচেস্কো কুয়েরোলো। নির্মাণকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। বলা হয়, কেবল এই একটি কাজের জন্যেই কুয়েরোলো বিশ্বের প্রথম সারির একজন ভাস্কর হিসেবে নিজের স্থান উজ্জ্বল অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছেন, যা কোনও দিন ম্লান হবে না। ম্লান হবে কী করে? ১৭৫২ থেকে ১৭৫৯, প্রায় সাত বছর ধরে দিসিনগানোর কাজ করেছেন একটানা... একা হাতে। অক্লান্ত পরিশ্রম, একাগ্র সাধনা। অবশেষে ফুটে উঠেছে মর্মর-ক্ষোদিত সেই মূর্তিযুগল - এক মৎস্যজীবী, তার নিজের জালেই জড়িয়ে পড়েছে; আর তাকে মুক্ত করছে এক বালক দেবদূত। বালক দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর রূপক এক গোলকের ওপর, আর পায়ের কাছে রাখা উন্মোচিত বাইবেল গ্রন্থ।

দেবদূতের মাথায় মুকুট থেকে নির্গত অগ্নি-শিখা, অঙ্গের বস্ত্রে ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠেছে নিখুঁত শৈল্পিক ছোঁয়া। বালক দেবদূত একহাত বাড়িয়ে সেই জাল ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, মুক্তি দিচ্ছে নিজের জালে জড়িয়ে পড়া মৎস্যজীবীকে। মার্বেল পাথর কেটে জন্ম দেওয়া এই জালের কাজই দিসিনগানোকে এক আলাদা মাত্রায় নিয়ে গেছে। এই জালের জন্যই এই ভাস্কর্যের ছবি প্রথমবার দেখে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে ছিলাম! এতটাও সূক্ষ্ম কাজ করা যায় মর্মর-মূর্তির ওপর! অনেকে একঝলক দেখে ভাবতেন ছোট ছোট মার্বেল পাথরের খণ্ড জড়িয়ে জালের আকার দিয়ে তারপর একত্রিত করে এমন রূপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন, কেবল একটি মার্বেল পাথরের বৃহৎ খণ্ড থেকেই এই ভাস্কর্য নির্মিত। এই কারণেই কুয়েরোলো এই বিস্ময়কর কীর্তির জন্য বন্দিত! 

সেই সময়ের বহু সম্মানিত ভাস্করও জালের ওই সূক্ষ্ম হাতের কাজটি ছুঁতে সংকোচ করতেন... পাছে, হাতের চাপ লেগে কোনোভাবে জালের কোনও ক্ষতি হয়, জালটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়!

যেহেতু ভাস্কর্যটি অ্যালিগোরিকাল, তাই এর আর একটি অংশের কথা না বললে বিবরণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মূর্তিটি যে পাথরের বেদীর ওপর স্থাপিত, সেই বেদীর গায়ে আরও একটি মোটিফ খোদাই করা আছে - প্রভু যীশু এক দৃষ্টিহীনকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিচ্ছেন।  মূল ভাস্কর্যের রূপকটির সঙ্গে বাইবেলের যোগসূত্রটি স্পষ্ট করে দেয় এই মোটিফ। যেন ছোট্ট করে পাদ-টীকা লিখে দেওয়া। 

প্রচলিত তথ্য, কোনো নির্মাণশালা, কারিগর-সহকারী বা অন্য কোনও সমকালীন শিল্পীর সহযোগিতা ছাড়া, পুরোপুরি একা সাত বছর ধরে এই ভাস্কর্যটিকে পূর্ণরূপ দিয়েছিলেন শিল্পী। চ্যাপেলের সংগ্রহশালা থেকে জানা যায়, সেই সময়ের বহু সম্মানিত ভাস্করও জালের ওই সূক্ষ্ম হাতের কাজটি ছুঁতে সংকোচ করতেন... পাছে, হাতের চাপ লেগে কোনোভাবে জালের কোনও ক্ষতি হয়, জালটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়!

অবশেষে কুয়েরোলোর পরিশ্রম সম্পূর্ণতা লাভ করার পর, রাইমন্দো দি সাংরোর উদ্যোগে দিসিনগানোকে সানসেভেরো চ্যাপেলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই থেকে আজ অবধি, এই ভাস্কর্য চ্যাপেলেই সংরক্ষিত আছে। 

https://www.youtube.com/watch?v=iUDo7KTW18Q

সত্যি বলতে, এই ইল দিসিনগানো বা ভ্রম-মুক্তি অথবা পাপ-মুক্তির প্রতীক এই ভাস্কর্যের সঙ্গে রাইমন্দো নিজেও কোনোভাবে জড়িয়ে আছেন। রাইমন্দোর বাবা অ্যান্তোনিও দি সাংরো তাঁর স্ত্রীয়ের অকাল মৃত্যুর পর পারিবারিক জীবনে নিরাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ছেলে রাইমন্দোকে তার পিতামহ পাওলো দি সাংরোর দায়িত্বে রেখে গৃহত্যাগী হন অ্যান্তোনিও। উচ্ছৃংখল এবং ঘটনাবহুল জীবনের নেশায় চূড় হয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌবনের ক্ষমতা আর বেপরোয়া ভাব দুটোই কমে আসে। অ্যান্তোনিওকেও বৃদ্ধ বয়সে ফিরে আসতে হল নেপল্‌সে, নিজের পরিবারের কাছে। শেষ বয়সে তাঁকে এক নির্মোহ জীবন কাটাতে দেখা যেত, নিজের জীবনের ভুলগুলোর জন্য তীব্র অনুতাপ; সাত্ত্বিক জীবনধারণের আড়ালে অতীতকে সরিয়ে রাখার প্রয়াস। অ্যান্তোনিও-র জীবনাবসানের পর, তাঁর শরণাগত হওয়ার ইচ্ছেকেই যেন রাইমন্দো দেখতে চেয়েছিলেন ইল দিসিনগানোর সেই মৎস্যজীবীর মধ্যে।

আসলে, বৃহৎ দর্শনের কাছে অ্যান্তোনিও এবং তার জীবনও রূপক মাত্র। মানুষের এমন ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ জীবনগুলো না থাকলে, মুক্তির পবিত্র আলো এত উজ্জ্বল হত না। বাঁধন না থাকলে, মুক্তির অন্বেষণই থাকত না। সেই অন্বেষণের বীজ নিয়ে প্রকট হত না 'দ্য রিলিজ ফ্রম ডিসেপশন'-এর মত বিস্ময়। শিল্পীর মনে লালিত ছিল বলেই না রূপ নিল এই ভাবে! 

More From Author See More