‘চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা’-র এই বিরাট জগতের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের সভ্যতা। সৌরজগতের সব সদস্য মিলে বেশ হেসেখেলেই দিন কাটছে আমাদের। মধ্যমণি সূর্যের আলো পৌঁছে যায় সুদূর নেপচুন পর্যন্ত। দিন-রাতের এই অদ্ভুত খেলার মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের রহস্যগুলোর পিছনে ধাওয়া করি আমরা। হঠাৎ একদিন বিজ্ঞানীরা দেখলেন, আকাশের সমস্ত নক্ষত্রের গতিবিধি বদলে গেছে। কয়েকদিন আগে যেভাবে তারা আমাদের সামনে আসছিল, আজ কেমন যেন ওলোটপালোট! কিন্তু এমন কেন? তলিয়ে দেখতে গিয়েই চমকে উঠলেন বিজ্ঞানীরা। আমাদের সৌরজগতটাই যে সরে গেছে অনেকটা! একটা নতুন জায়গায় হাজির হয়েছে সে। পৃথিবী, মঙ্গল, চাঁদ, সূর্য, বৃহস্পতি— সবাই নিজের নিজের ‘নতুন’ অবস্থানের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এমন ঘটনা দেখে তাজ্জব বিজ্ঞানীরা!…
অনেকটা কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনাচ্ছে কি? ছোটো থেকে পড়ে এসেছি, সূর্য এক জায়গায় স্থির; তাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে সব গ্রহ। গ্রহের চারদিকে আবার উপগ্রহ। যাই হয়ে যাক না কেন, নিজের অবস্থান থেকে একচুলও সরবে না তারা। কিন্তু এটা কী হল? সূর্য সমেত পুরো সৌরজগতটাই উড়ে গেল মহাকাশের অন্য জায়গায়! এখনই চিন্তার কিছু হয়নি। বলা ভালো, একপ্রকার কল্পবিজ্ঞানের পোশাকই বোনা হয়েছে এখানে। আর বুনেছেন বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ জুইকি…
পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ফ্রিৎজ জুইকি পরিচিত নাম। তাঁর হাত ধরেই বিজ্ঞান প্রথম শুনেছিল ‘ডার্ক ম্যাটার’ শব্দটি। মহাকাশে এমন ‘এনার্জি’ও নাকি আছে, যার অস্তিত্বকে খাতায় কলমে প্রমাণ করা যায়, কিন্তু তাকে দেখা সম্ভব নয়! এমন ‘অশরীরী’ কি সত্যিই এই ব্রহ্মাণ্ডে? জুইকি নিজেই সামনে আনলেন সেই অদ্ভুত শক্তিকে। অ্যান্টিম্যাটার থেকে তৈরি হওয়া এই অদৃশ্য এনার্জির নাম দিলেন ‘ডার্ক ম্যাটার’। পরবর্তী বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা এর রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত থাকবেন। অবশ্য ফ্রিৎজ জুইকি’র অবদান এখানেই থেমে থাকে না। বারবার তাঁর মন ছুটে যায় বাইরের জগতের দিকে। টেলিস্কোপের কাচে জ্বলে ওঠে সবটা। তার হাত ধরে একে একে আসতে থাকে ‘সুপারনোভা’, ‘নিউট্রন স্টার’-এর মতো মহাজাগতিক বস্তুরা। বিজ্ঞানের বইগুলো পরিচিত হয়ে ওঠে সেই নামে…
গবেষণার কাজ করতে করতে মনটা হারিয়ে যেত সেই মহাকাশেই। আর সেখান থেকেই খুঁজে আনতেন একের পর এক অদ্ভুত সব তত্ত্ব। সেই পথ ধরেই হাজির হল সৌরজগত। ১৯৬১ সাল। ‘ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশ পেল ডঃ ফ্রিৎজ জুইকি’র একটি লেকচার। নাম ‘দ্য মার্চ ইনটু ইনার অ্যান্ড আউটার স্পেস’। সেখানে এক আজব থিয়োরি সামনে রাখলেন জুইকি। বিজ্ঞানীরা কখনও উচ্চমানের টেলিস্কোপ তৈরি করছেন, কখনও রকেটে করে চলে যাচ্ছেন মহাকাশে। গ্রহগুলোতে বিশেষ যানও পাঠানো হচ্ছে। কেমন হয়, যদি গোটা সৌরজগতটাকেই বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেই কাঙ্খিত জায়গায়?…
সবাই অবাক! এ কী বলছেন জুইকি? একটা আস্ত সৌরমণ্ডলকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া! ‘আরে এটা তো সৌরজগত, তোমার বাড়ির টেবিল নাকি!’ ফ্রিৎজ জুইকি কিন্তু নিজের ভাবনায় অটুট থাকলেন। কেন নয়! সৌরজগতের মূল চালিকাশক্তি হল সূর্য। সে-ই সবার মাঝখানে থেকে মহাকর্ষের সুতো ঘোরাচ্ছে। যদি কোনোভাবে সূর্যের গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়ে মহাকাশের নির্দিষ্ট একটি স্থানে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে ক্ষতি কী! বিজ্ঞানীদের কাজও সহজ হবে, আবার মানুষের মহাকাশ ঘোরাও হবে। দরকারে সূর্যকে একটা ‘জেট প্লেন’-এর ইঞ্জিন হিসেবে ভাবা যেতেই পারে। আচ্ছা, বৃহস্পতি গ্রহ তো এত বড়ো। তাকে নিয়ে যদি সমস্যা হয়? ফ্রিৎজ জুইকি’র সটান উত্তর, ‘তাহলে তাকে কেটে নেওয়া হবে! তাহলে মহাকর্ষ বল কমবে।’ এমনকি এও বলেছিলেন, দরকারে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওদেরকে সরাতে হবে…
তখনকার দিনে এমন কথা শুনে কী মনে করেছিলেন বিজ্ঞানীরা? বলা বাহুল্য, সেরকমভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়নি এই অদ্ভুত তত্ত্বের দিকে। একজন এত বড়ো বিজ্ঞানী কী করে এমনটা ভাবলেন? আজকের দিনে দাঁড়িয়েও কেউ এমনটা বললে হয়তো এরকমটাই মনে করতাম আমরা। কিন্তু কে-ই বা বলতে পারে ভবিষ্যতের কথা! হয়ত ভবিষ্যতে এমনই কোনো আশ্চর্য জিনিস দেখব আমরা। আর আড়ালে বসে মুচকি মুচকি হাসবেন ফ্রিৎজ জুইকি!
আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী শেখর বসু, শেষ হল বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার একটি অধ্যায়
Powered by Froala Editor