মানুষই জন্ম দিয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের, মৃত্যুও 'মিথ্যা'! আশ্চর্য থিওরি মার্কিন গবেষকের

‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথায় কবে…’ এমনটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। এমনটাই তো সকলে শিখে এসেছি, প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। এখন যদি হঠাৎ করে আপনাকে বলা হয় এই উপলব্ধি আসলে সম্পূর্ণ মিথ্যে, মৃত্যু (Death) বলে আদতে কিছু নেই? হ্যাঁ, ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। মজার ছলে আড্ডায় এমন প্রশ্ন করলে, উঠতে পারে হাসির রোলও। কিন্তু একদল গবেষকের অভিমত এমনটাই। মানুষ অমর। মৃত্যু বলে আদতে নাকি কিছু নেই।

আশ্চর্য এই তত্ত্বের পিছনে রয়েছেন মার্কিন বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক রবার্ট ল্যানজা (Robert Lanza)। ২০০৭ সাল। ‘দ্য আমেরিকান স্কলার’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় ল্যানজার একটি প্রবন্ধ— ‘আ নিউ থিওরি অফ দি ইউনিভার্স’। প্রথমবারের জন্য ব্রহ্মাণ্ডের বর্ণনা দিতে সেই প্রবন্ধে ‘বায়োসেন্ট্রিজম’ শব্দবন্ধটির ব্যবহার করেন তিনি। ল্যানজা পদার্থবিজ্ঞান, গণিত বা রসায়নের ওপরে সর্বোত্তম হিসাবে জায়গা দিয়েছিলেন জীববিজ্ঞানকে। 

ল্যানজার মতে, আমরা যতটুকু জানি, যতটুকু প্রত্যক্ষ করি, তার ভিত্তিতেই আমরা জন্ম দিয়েছি ব্রহ্মাণ্ডের। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মানুষ। টেলিস্কোপ আবিষ্কারের আগে যে ব্রহ্মাণ্ড ছিল না, সূর্যকে গ্রহরা প্রদক্ষিণ করত না— এমনটা নয়। ঠিক সেভাবেই মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থাতে শনাক্ত করা কিংবা পর্যবেক্ষণ করার মতো কোনো প্রযুক্তি আজও মানুষের হাতে আসেনি বলেই আমরা ধরে নিই মৃত্যুতে সব শেষ। 

ল্যানজার এই তত্ত্ব সে-সময় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা দুনিয়ায়। দ্বিবিভক্ত করে দিয়েছিল বিজ্ঞানীদেরও। অনেকে যেমন তাঁর এই তত্ত্বের সমর্থন করেছিলেন অকুণ্ঠভাবে, তেমনই আবার বিদ্ধ হতে হয়েছিল সমালোচনাতেও। তাঁর এই তত্ত্ব বিজ্ঞান নয়, বরং দর্শনের ক্লাসে পরানো উচিত বলে অভিযোগ করেছিলেন অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পদার্থবিদ লরেন্স ক্রাউস। 

এই ঘটনার পর ২০০৯ সালে একটি আস্ত বই প্রকাশ করেন ল্যানজা। ‘বায়োসেন্ট্রিজম: হাউ লাইফ অ্যান্ড কনসায়নেস ইজ দ্য কিস টু আন্ডারস্ট্যান্ডিং দি ইউনিভার্স’। এই গ্রন্থে শুধু তত্ত্বই নয়, তার সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের একাধিক আঙ্গিককেও সঙ্গী করেছেন তিনি। ইয়ং-এর ডবল স্লিট পরীক্ষার ফলাফল কিংবা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্য নিয়ে দেখাতে চেয়েছেন মৃত্যুর পর মানুষ চলে যায় অন্য এক ব্রহ্মাণ্ডে। 

ব্যাপারটা একটু সহজ করে বিস্তারে বলা যাক। আমরা সাধারণত ৪টি মাত্রাকে বুঝতে পারি। যার মধ্যে একটি হল সময়, অন্য তিনটি হল দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা। তবে স্ট্রিং থিওরি কিংবা অন্যান্য একাধিক তত্ত্ব ও পদার্থবিদ্যার মডেল অনুযায়ী, ১১টি মাত্রা-বিশিষ্ট একটি ভয়েডে রয়েছি আমরা। যা এখনও পর্যন্ত খাতায় কলমে প্রমাণ হয়নি কিছুই। শুধু গাণিতিক সমীকরণই তার ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। এই তত্ত্ব থেকেই উঠে আসে প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল জগতের কথাও। 

ল্যানজার মতে মৃত্যু এমন একটা অবচেতন অবস্থা, যে সময় আমরা এই সমান্তরাল জগতের উপলব্ধি করতে পারি। অন্যদিকে জীবন হল, এক সমান্তরাল জগৎ থেকে অন্য জগতে চলে যাওয়ার মধ্যবর্তী অবস্থান। জীবদ্দশায় মানুষ যা যা শেখে, জ্ঞান অর্জন করে, সেগুলি তথ্য হিসাবে সংরক্ষিত হয় মানুষের মস্তিষ্কে। মৃত্যুর পর দেহের ভর অপরিবর্তিত থাকলেও, ভর-শক্তির সংরক্ষণ সূত্র অনুযায়ী, মানুষের অর্জিত জ্ঞান রূপান্তরিত হয় অন্য এক শক্তিতে। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি কিংবা লোককথায় যাকে ‘আত্মা’ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। 

ল্যানজার এই তত্ত্ব শুনে তাঁকে পাগল বলে ভাবাই স্বাভাবিক। তবে মজার বিষয় হল, ল্যানজার এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন কিংবদন্তি পদার্থবিদ তথা নোবেলজয়ী রজার পেনরোজের মতো গবেষকরা। পদার্থবিদ্যার আঙ্গিকে তিনিও জানিয়েছেন মৃত্যু আসলে একধরনের অবচেতন অবস্থা। ল্যানজা নিজেও কেবলমাত্র তাত্ত্বিক নয়। জীববিদ্যায় স্টেমসেল এবং দৃষ্টিহীনতার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ওপর একাধিক উল্লেখযোগ্য গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে তিনি। ‘টাইম’ পত্রিকার ‘সেরা ১০০ অনুপ্রেরক’-এর তালিকাতেও রয়েছে তাঁর নাম। কাজেই নেহাতই ফেলা দেওয়া যায় না তাঁর বক্তব্য। এটাই আমাদের অজানা বাস্তব, এমন সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। অবশ্য তাঁর এই তত্ত্ব সর্বোত্তম সত্যি কিনা সেই উত্তর দেবে সময়ই…

তথ্যসূত্রঃ
১. Does the Soul Exist? Evidence Says ‘Yes’, Robert Lanza M.D., Psychology Today
২. Is Death an Illusion? Evidence Suggests Death Isn’t the End, Robert Lanza M.D., Psychology Today
৩. The Secret of the World: Experiments Suggest We’re the Key to the Universe, Robert Lanza M.D., Psychology Today
৪. “Illusion of Death” -In the Quantum Universe We Exist Indefinitely, Daily Galaxy
৫. Roger Penrose On Why Consciousness Does Not Compute, Steve Paulson, Nautilus

Powered by Froala Editor

Latest News See More