বাইরে থেকে দেখতে আর পাঁচটা গির্জার থেকে আলাদা কিছুই নয়। প্রার্থনাগৃহটি দেখেও আলাদা কিছুই মনে হয় না। কিন্তু প্রার্থনা শেষ করেই দর্শনার্থীরা এগিয়ে যান মাটির নিচের ঘরটির দিকে। কিন্তু, কী আছে সেখানে? আসলে ওই ঘরটির টানেই দেশবিদেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে এসেছেন চেক রিপাবলিকের এই আপাত সাদামাটা গির্জায়। আর হঠাৎ কেউ এসে পড়লে ঘরের সামনে এসেই লাগবে চমক।
চেক রিপাবলিকের সেডলেক শহরের গথিক গির্জার সিঁড়ি দিয়ে নেমে প্রথম দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই গা ছমছম করে উঠবে। দরজার মাথায় সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে একটি শিকল। না, ধাতু বা কাঠের তৈরি নয়, শিকলটি বানানো হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের মাথার খুলি দিয়ে। শুধু এই শিকলটিই নয়, ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য হাড়। দরজার ঠিক উল্টোদিকে আছে একটি ক্রুশ চিহ্ন। সেটিও তৈরি হয়েছে ফিমার দিয়ে। দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে সাজানো রয়েছে মানুষের শরীরের নানা অঙ্গের হাড়। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অবশ্যই মাথার উপরের ঝাড়বাতিটা।
শোনা যায় এই ঝাড়বাতিটির মধ্যে মানুষের শরীরের ২০৬টি হাড়ই আছে। তবে তাদের সংখ্যা সমান নয়। কোনোটি হয়তো আছে মাত্র একটিই। আর মোমবাতি রাখার প্রতিটি জায়গায় আছে মানুষের মাথার খুলি। অন্ধকার ঘরে ঝাড়বাতির নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় প্রতিটি খুলি যেন জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে নিচের মানুষগুলির দিকে। এমন একটা দৃশ্য দেখলে গা শিরশির করে ওঠে বৈকি! তবে শুধু ভয় পাওয়ার জন্য নয়, জীবনমৃত্যুর রহস্য খুঁজতেও অনেকে এই ঘরে ফিরে ফিরে আসেন। এই মৃতের স্তূপের মধ্যেই যেন শান্তি খুঁজে পান অসংখ্য মানুষ।
তবে একটা প্রশ্ন নিশ্চই মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে, একটা গির্জাকে এভাবে সাজিয়ে তোলার কারণ কী? ১৮৭০ সালের আগে কিন্তু দৃশ্যটা এমন ছিল না। গির্জার পাশে শুধু ছিল বিরাট একটি কবরস্থান। কিন্তু সেখানে মৃতদেহের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে আর নতুন কবরের জায়গা ছিল না। তাই ফ্রান্সিস রিন্ট নামে এক কাঠের শিল্পীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, এইসমস্ত কঙ্কাল দিয়ে একটি ঘরকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলার। রিন্ট যে সেই কাজ বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই করেছিলেন, সেকথা বলাই বাহুল্য। তবে ইতিহাসের জন্ম আরও বহু আগে। আর তাকে ঘিরে আছে নানা জনশ্রুতিও।
আরও পড়ুন
হ্রদের নিচে ১৬০০ বছরের প্রাচীন গির্জা, দূষণ কমায় দেখা যাচ্ছে খালি চোখেই
শোনা যায় প্রায় হাজার বছর আগে এক ধর্মযাজক সেডলেক শহর থেকে তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন জেরুজালেম। সেখান থেকে খানিকটা পবিত্র মাটি নিয়ে এসে ছড়িয়ে দিয়ছিলেন গির্জার চারিদিকে। সেই থেকেই এই গির্জা পবিত্র কবরস্থান হিসাবে পরিচিত। এর কয়েকশ বছরের মধ্যেই প্লেগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত ইউরোপ জুড়ে। সেডলেক শহরেও হানা দেয় এই মহামারী। তখন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ এই সমাধিক্ষেত্রে অন্তিম শয্যায় শায়িত হয়। ক্রুসেডের সময় আরও ১০ হাজার মানুষের মৃতদেহ রাখা হয় সেখানে। এছাড়া সাধারণ ও অভিজাত মানুষের মৃতদেহ কবর দেওয়ার রেওয়াজ তো ছিলই।
ইউরোপের নানা শহরে অবশ্য নরকঙ্কাল শোভিত গির্জার সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। তবে সেডলেক অসিওলারি-র নাম উঠে আসে সবার আগে। আর তার কারণ এই গির্জার অদ্ভুত অলঙ্করণ। এই কৃতিত্ব অবশ্য সেই কাষ্ঠশিল্পী ফ্রান্সিস রিন্টের। তবে কালের নিয়মে তাঁর নাম হারিয়ে গিয়েছে মানুষের মন থেকে। থেকে গিয়েছে শুধু তাঁর কাজ। আজও যেখানে জীবন আর মৃত্যু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিসাবনিকাশ করে।
আরও পড়ুন
১০০১টি গির্জার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে, কেমন আছে তুরস্কের এই পরিত্যক্ত শহর?
Powered by Froala Editor