নিজের সেনাবাহিনীর ওপরেই গুলিবর্ষণ, স্তালিনের নির্দেশে রেড-আর্মির ‘জেনোসাইড’

প্রযুক্তি, অভিজ্ঞতা, বা দক্ষতা— কোনোদিক থেকেই নাৎসি সেনাদের সমতুল্য ছিল না সোভিয়েতের দক্ষিণ-পূর্ব মিলিটারি ফ্রন্ট। এমনকি স্তালিন নিজেও ভাবতে পারেননি হিটলারের প্রত্যাঘাত ধেয়ে আসবে ইউক্রেনের দিক থেকে। কাজেই ইউক্রেন সীমান্তে সেভাবে সামরিক নিরাপত্তায় জোরও দেননি স্তালিন। ১৯৪২-এর মাঝামাঝি সময় সেটা। চারিদিক থেকেই প্রায় ঘিরে ফেলেছে জার্মান সেনারা। ওপর থেকে বোমাবর্ষণ করছে নাৎসি ফাইটার। সামনে থেকে মুহুর্মুহু আঘাত হানছে পদাতিক সৈন্য এবং জার্মান ট্যাঙ্ক। বাঁচার একটাই পথ পিছনে ফিরে আসা। তবে সেনাঘাঁটিতে আর ফেরা হল না রেড-আর্মির দক্ষিণ-পূর্ব রেজিমেন্টের সৈন্যদের। পিছন থেকেও ধেয়ে এল গুলি। রক্তস্নাত হল সোভিয়েতের মাটি।

বিশ্বযুদ্ধ বললেই প্রথমেই উঠে আসে হিটলারের কথা। নৃশংসতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তবে পারতপক্ষে হিটলারের থেকে এতটুকুও পিছিয়ে ছিলেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাকি ওয়ারলর্ডরা। এমনকি কমিউনিস্ট ‘জননেতা’ স্তালিনও। স্রেফ নিজের গোয়ার্তুমির জন্যই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন নিজের সম্পূর্ণ বাহিনীকে। এমনকি নিজের সেনাবাহিনীর ওপরেই গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন স্তালিন।

গল্পটা শুরু করা যাক আরেকটু পিছন থেকে। ১৯৪১ সাল। ২২ জুন। ১২৯ বছর আগের স্মৃতির যেন পুনরাবৃত্তি হল। নেপোলিয়নের পদচিহ্নকেই অনুসরণ করলেন হিটলার। অপারেশন বারবারোসা। রাশিয়া থমকে গেল জার্মানির অতর্কিত আক্রমণে। ব্রিটেনকে সম্পূর্ণ না হারিয়ে হিটলারের দ্বিতীয় ফ্রন্ট যে রাশিয়া আক্রমণ করতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবেননি স্তালিন। তখনও প্রস্তুতি নিয়ে উঠতে পারেনি তাঁর সেনাবাহিনী। পোল্যান্ড সীমান্ত থেকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে প্রায় ৬০০ মাইল জমি অধিগ্রহণ করল জার্মানি। নাৎসি সেনাবাহিনী পৌঁছে গেল মস্কোর দোরগোড়ায়। এমনকি পরিস্থিতি এমনই হয়ে উঠেছিল, যে হিটলার নিশ্চিত ছিলেন আর মাস তিনেকের মধ্যেই কবজায় চলে আসবে রাশিয়া।

তবে শেষ পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছিলেন হিটলার। একেবারে নেপোলিয়নের মতোই। ১৯৪১ সালের শেষের দিক সেটা। রাশিয়া জুড়ে মারণ-ফাঁদ পাতল ডিসেম্বরের শীত। সে-ফাঁদে এক কথায় আক্ষরিক অর্থেই জমাট বেঁধে গেল নাৎসি সেনাপক্ষ। চতুর্দিক বরফে বরফে সাদা হয়ে আছে। নেই প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রও। অন্যদিকে নিম্ন তাপমাত্রায় জার্মান ট্যাঙ্ক, মর্টারগুলিও। ঘণ্টাখানেক উত্তপ্ত না করলে কিছুতেই চালু হয় না ইঞ্জিন। 

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের ৭৬ বছর পরেও নাৎসি শাসন! জার্মানিতে আজও রয়েছে এই গ্রাম

এই তো মোক্ষম সুযোগ। প্রত্যাঘাত হানল রাশিয়া। তিন-চতুর্থাংশ নাৎসি সেনাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল রাশিয়ার মাটিতে। অন্যদিকে তখন হিটলারের ফ্রন্টলাইনকে একশো মাইল পিছনে সরিয়ে আত্মদম্ভে পরিপূর্ণ স্তালিন। আর হবে নাই বা কেন? ছ’মাসের টানা যুদ্ধে প্রথম জয়। ব্রিটেনের সমস্ত রেডিওতে তখন চলছে স্তালিনের জয়গান। ঘোষণা করা হচ্ছে, স্তালিনই হিটলারের যোগ্য প্রতিপক্ষ। কিন্তু কে-ই বা জানত ঋতু ঘুরলেই, আবার বদলে যাবে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি?

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরমে, ‘শত্রুপক্ষ’ আমেরিকার বুকে মার্চ করলেন হিটলার!

হলও তেমনটাই। ১৯৪২ সাল। আত্মবিশ্বস্ত স্তালিন মস্কোর দিক প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন জার্মানির বিরুদ্ধে। অথচ, হিটলারের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তুলনামূলকভাবে দুর্বল দক্ষিণ-পূর্ব সোভিয়েতে সেনা পাঠালেন তিনি। দু’তরফা সাঁড়াশি আক্রমণ। দ্বিতীয়বার ভুল করে বসলেন স্তালিন। সামর্থ্য, শক্তি কম জেনেও আক্রমণে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন দক্ষিণ-পূর্ব রেড-আর্মিকে। বাড়তি সামরিক প্রস্তুতির আগেই মুছে গেল সোভিয়েতের সেনাবাহিনীর একটা বড়ো অংশ। আর যাঁরা বেঁচে গেলেন, তাঁদের ততক্ষণে তিন দিক থেকেই ঘিরে ফেলেছে জার্মান সেনারা। যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত। বাঁচার পথ একটাই। ইউক্রেনের জমি ছেড়ে পিছু ফিরে আসা।

আরও পড়ুন
সুড়ঙ্গের ভিতরে ২৭০টি মৃতদেহ! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন ফ্রান্সে

তবে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থাকলেন স্তালিন। পিছু হটা যে তাঁর সাজে না। বারবারোসার ডিসেম্বরের জয়ের পর এমন ‘আত্মসমর্পণ’ যে কালিমালিপ্ত করবে তাঁর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে! ফলত, নির্দেশ গেল মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যেতে হবে সৈন্যদের। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসে বিবেচিত হবে কাপুরুষতা হিসাবে। যার শাস্তি হবে মৃত্যু। বেস লাইনেও আদেশ গেল সামনের সারির সৈন্যরা পিছু ফিরলেই গুলি চালাতে হবে পিছন থেকে। হ্যাঁ, নিজের সৈন্যদের প্রতিই এমন কঠোরতম সিদ্ধান্ত নিলেন স্তালিন। রাশিয়ানদের গুলিতেই নিহত হলেন প্রায় দশ থেকে বারো হাজার রেড-আর্মির যোদ্ধা। বন্ধ করে দেওয়া হল সমস্ত বাঙ্কারও। সামান্য ফাঁক থেকে শুধু ঝলসে উঠল কিছু বন্দুক আর ট্যাঙ্ক। সতীর্থদের রক্তেই হাত ভেজালেন বেস ফ্রন্টের কমান্দান্তেরা। সাধারণ যোদ্ধা ছাড়াও, সেদিন রেহাই পায়নি উচ্চ পদস্থ আধিকারিকরা। ৩৮ থেকে তাঁদের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১৫-তে।


না, ইউক্রেনের সেই যুদ্ধ জিততে পারেনি সোভিয়েত। শেষ পর্যন্ত লক্ষাধিক সোভিয়েত যোদ্ধার প্রাণ গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। তবে বিন্দুমাত্র অনুশোচনায় কি দগ্ধ হয়েছিলেন স্তালিন? বোধ হয় না। কারণ, তিনি যে ‘লৌহমানব’। ইস্পাতে তৈরি স্তালিন জার্মানিকে জব্দ করতে এবার হাত পাতলেন ব্রিটেনের কাছে। একমাত্র রাজ্য পুনর্দখলই শান্তি দিতে পারে তাঁকে। ১৯৪৫-এর মে মাসে অবশ্য শেষ হাসি হেঁসেছিলেন স্তালিনই। অধিকাংশ রেকর্ড থেকেই পরে মুছে দেওয়া হয়, ১৯৪২ সালে তাঁর নেওয়া সেই বর্বরোচিত সিদ্ধান্তের কথা। তবে সেই তথ্য ধরে রাখে কিছু সৈনিকের শেষ জবান এবং সেনাপ্রধান জর্জি ডিমোট্রোভের ডায়েরি। জার্মান রেডিও-তে দেওয়া হিটলারের একটি ভাষণও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে সেই সময়কার। “Only pigs eat the flesh of their own.” কমিউনিস্ট সোভিয়েতের ‘জননেতা’ হিসাবে পরিচিতি পেলেও স্তালিনের অপর চেহারাও যে সত্যি, এটুকুই তার প্রমাণ দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট… 

তথ্যসূত্র—
১. The bittersweet victory of Stalin in WW2, Man Of Steel, Timeline
২. ভ্লাদিমির ওগ্রিজকোর জবানি (১ম সোভিয়েত ফ্রন্ট সেনাপ্রধান, এনকেভিডি ডিভিশন)

Powered by Froala Editor

More From Author See More