বতর্মান যুগে বিক্রি করতে জানাটা খুব দরকার। পুঁজিবাদের জয়জয়কার যখন চারিদিকে, মানব সভ্যতার উন্নতি মানে যখন প্রাচুর্যের আস্ফালন, যখন রাষ্ট্র নতুন ভারতের স্বপ্ন বিক্রি করছে আর আমরা সেটা নির্দ্বিধায়ে মেনে নিচ্ছি, তখন এই বিক্রি হওয়া আর বিক্রি করাটা বেঁচে থাকার জন্য খুব জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। আর্থার মিলারের 'ডেথ্ অফ এ সেলসম্যান', সেই সময়ের ফাঁপা আমেরিকান ড্রিমের দিকে স্পষ্ট ভাবে তর্জনী নিক্ষেপ করেছিল, প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত যে মিথ্যে দিয়ে সেলাই করা স্বপ্নকে এক ভ্রান্ত আত্মশ্লাঘার সাথে জড়িয়ে রাখে তার নগ্ন রূপ তুলে ধরেছিল। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সেই নাটকটি আজকের ভারতে ভয়াবহ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রথমে 10th Planet-কে সাধুবাদ জানাতে হয় এরকম একটা ক্ল্যাসিকের পুনর্মূল্যায়নের জন্য।
শুরু করা যাক এই নাটকটির তর্জমা দিয়ে। একবারের জন্যেও মনে হয়নি এটা কোনো বিদেশি নাটক। এ যেন ভারতেরই ঘটনা, খুব কাছের একটা দ্বন্দ্ব। এর অনেকটা কৃতিত্ব ভাষার সাবলীলতার। এই নাটকটি স্বনামধন্য নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত থেকে অভিনেতা অঞ্জন দত্ত অনেকেই অনুবাদ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্ত শরণ্য দে (এই নাটকের পরিচালক) অনুবাদক হিসাবে অনেক স্বাধীন। পূর্বে বহুবার মঞ্চস্থ এই নাটকের নির্দেশকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তর্জমার ক্ষেত্রে বড় বেশি সাবধানী ছিলেন। আর এখানেই শরণ্য দে সফল হয়েছেন নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে। এ যেন সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত আদর্শ একুশ শতাব্দীর অনুবাদ, যেখানে শুধু ক্রাইসিস নয়, ভাষাটাও আজকের।
এ গল্প একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প, যেখানে অভিরূপ (Willy Loman) একজন ব্যর্থ সেলসম্যান। সে বিশ্বাস করে যে সে জীবনে সফল। কিন্তু বাস্তব হল, সফলতা সে কখনও চোখে দেখেনি। তার দুই ছেলে ধ্রুব (Biff ) আর আনন্দ (Happy)। অভিরূপের বিশ্বাস ছিল যে ধ্রুব জীবনে অনেক কিছু করবে, কিন্তু ধ্রুব কিছুই করতে পারেনি। আসলে ধ্রুব জেনে গিয়েছিল ছিল যে সে এবং তার পরিবার খুবই সাধারণ। কিন্তু অভিরূপ জোর করেই বিশ্বাস করে যে ওরা কেউ সাধারণ মানুষ নয়। সে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকে কিছু অসাধারণ ঘটার। এমন কিছু, যা এক লহমায় তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। এই মিথ্যে স্বপ্নটাকেই সত্যি বলে বিক্রি করতে চায় অভিরূপ, কিন্ত এখানেও জীবন তাকে ব্যর্থতা ছাড়া কিছু দেয় না। এই ক্রমাগত ভেঙে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে এক ভয়াবহ দ্বন্দ্ব, যা এক মুহূর্তে তোলপাড় করে দেয় মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ, সম্পর্ক, স্বপ্ন। এখানে অভিরূপের স্ত্রী লীনা(Linda) একমাত্র খুঁটি, যার জন্য সংসারটা টিকে আছে। কিন্তু টিকে থাকা মানেই তো বেঁচে থাকা নয়! নিজেদের গড়া মিথ্যা স্বপ্নের জালে নাগপাশের মতো পিষ্ট হতে থাকে এক পরিবারের চারটি জীবন।
গল্পের পরে আসা যাক নির্দেশনার খুঁটিনাটিতে। মঞ্চ পরিকল্পনা অত্যন্ত সামান্য, তবু প্রাসঙ্গিক। আজকাল বাংলা রঙ্গমঞ্চের গড় প্রবণতার বিরুদ্ধ পথে হেঁটেছে এই নির্মাণ। তিনটে ফাঁকা ফ্রেম যেন মধ্যবিত্তর ফাঁপা অস্তিত্বই জানান দিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় থিয়েটারের যে প্রপস-এর বাহুল্য স্বচ্ছন্দে বর্জন করেও বাস্তবধর্মী নাটক করা যায়, এ তারই প্রমাণ। বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে পরিচালকের ইন্টারভ্যাল ও ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্য নির্মাণের সুনিপুণ পরিকল্পনা।
বছর বাইশ তেইশের শরণ্য দে এক ষাট বছরের বৃদ্ধ, অভিরূপ চ্যাটার্জীর ভূমিকায় যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া এই বৃদ্ধের চরিত্র দর্শকদের সমবেদনা পেতে বাধ্য। বিশেষ বিশেষ জায়গায় কমিক্ টাইমিং থেকে চরিত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবনা সবকিছুই সুচিন্তিত। শরণ্যের পাশাপাশি বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য সমুদ্রনীল সরকার অভিনীত ধ্রুব চরিত্রটি। বাবা-ছেলের দ্বন্দ্ব ভালোবাসার বিভিন্ন দৃশ্য দর্শককে বারবার আবেগ প্রবণ করে। নাটক শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই অভিরুপ চ্যাটার্জির পরিবারের গল্প সবার গল্প হয়ে ওঠে। ধ্রুব-র অন্তর্দ্বন্দ্ব, চারিত্রিক জটিলতা ও তোলপাড় হয়ে যাওয়া মনন দক্ষতার সঙ্গে অভিনীত এবং নির্মিত হয়েছে। সুমিত দে, আনন্দের চরিত্রে যথাযথ – ওর ওই উদাসীন মনোভাবাপন্ন চরিত্র আমাদের মিথ্যাকে মেনে নিয়ে সুখী হতে শেখায়। বড়দা-র চরিত্রে হরিদাস দে এক অন্য অভিঘাত সৃষ্টি করে। একটি অ্যাবস্ট্রাক্ট চরিত্রকে মঞ্চে রক্তমাংসের করে তোলার মতো কঠিন কাজে তিনি সফল। বাদবাকি অভিনেতারা নিজেদের চরিত্রে যথাযথ।
তবে সৌমেন চক্রবর্তীর আলো অনেক জায়েগায় যেমন বিশেষ মুহূর্ত তৈরি করতে সাহায্য করলেও অনেক জায়গাতেই নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। নাটকটি কিছু জায়গায় বেশ দীর্ঘ লাগছিল। হয়ত সংলাপ কিছু বাদ দিলে মন্দ হয় না। অনেক জায়গায় সুস্মিতা চক্রবর্তী, যিনি লীনার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তাঁর সংলাপ অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল।
শেষ দৃশ্যে অভিরূপ আত্মহত্যা করে, যাতে তার মারা যাওয়ার পর ইনশিওরেন্সের টাকা ছেলেরা পায়। অভিরূপের বিশ্বাস, ওর ছেলেরা কিছু করতে পারবেই। পুঁজিবাদের গোলকধাঁধায় এই অনন্ত স্বপ্নের ফেরিওয়ালার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু সফলতা কী? এই প্রশ্নটা শেষ অবধি থেকেই যায়। আগে বাঙালি জীবনানন্দ দাশ কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-কে সফল বলত। আর এখন রোল মডেল আম্বানি – সাফল্যের মানে পাল্টাচ্ছে। সবাই কি তাহলে ওই পুজিঁবাদের অন্ধগলিতে ধিকি ধিকি আলোতে জ্বলা জোনাকিদের মতো সফলতা নামক মরীচিকা খুঁজে বেড়াচ্ছে এটা জেনেও যে একদিন তারাও ব্যর্থ হবে আর সেদিন তাদের ভেতরের ওই নাছোড়বান্দা সেলসম্যান, অভিরুপ চ্যাটার্জির মৃত্যু ঘটবে!