রুশ বিপ্লবের পর ঠাঁই কলকাতায়, শীতের বো ব্যারাক ও একটি রাশিয়ান পরিবারের গল্প

১৯১৭ সাল, যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়া। পুরো দেশ জ্বলছে, সকলের আশা রাশিয়ান বিপ্লব দেশকে নতুন মাত্রা দেবে। কিন্তু জনজীবন বিপন্ন, চাকরি নেই। এই অবস্থায় বছর ২২-এর এক তরুণ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে দেশ ছাড়লেন নিঃস্ব, কপর্দকহীন অবস্থায়। নানা দেশ ঘুরে অবশেষে বার্মায় পৌঁছোলেন তিনি, ডিমিট্রি কোভাল্ট। সেখান থেকে সাংহাই। কিছুদিন কাটিয়ে যোগ দিলেন রাশিয়ান সার্কাসে, এলেন ভারতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাকে উদ্বাস্তু ভেবে ঢুকিয়ে দেয় করেনটাইন ক্যাম্পে, অনেকটাই ডিটেনশন ক্যাম্পের ধাঁচে, কিন্তু হিটলারের ক্যাম্পের মতো অতটাও ভয়ঙ্কর নয়। সেখান থেকে আবার বেরিয়ে যোগ দিলেন রাশিয়ান সার্কাসে। চলে এলেন কলকাতায়। তার আগে এই করেনটাইন ক্যাম্পেই আলাপ হয় পর্তুগিজ রমণী গার্টহুড সালভাডোরের সঙ্গে। প্রেম হয়, সেখান থেকে বিয়ে। কলকাতায় পাকাপাকি বসবাস শুরু ১৯৩০ সালের আশেপাশে। পাকাপাকি ঠিকানা বৌবাজারের বো ব্যারাক। এখানেই জন্মালেন মেয়ে নাতালিয়া কোভাল্ট। রাশিয়া আর পর্তুগিজ রক্তের এক অসাধারণ ৭৯ বছরের নাতালিয়া, যিনি চির তরুণী। বেড়ে ওঠা কলকাতায়। কিন্তু এখনো বাংলা বলতে পারেন না নাতালিয়া। তা নিয়ে আফশোসও রয়েছে তাঁর। যৌবনে কীভাবে যেন এক কাশ্মিরী মুসলমান তরুণের প্রেমে পড়ে যান। বিয়েও করেন তাঁরা।

বো ব্যারাকের বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল নাতালিয়া আর তার নাতনি স্টেফিনি ঝাউয়ের সঙ্গে। নাতালিয়ার হয়ে বেশিরভাগ জবাব দিচ্ছিলেন স্টেফিনি-ই। থাকেন লন্ডনে, সেখানকার এক হাসপাতালের নার্স তিনি। আলাপচারিতায় উঠে এল নানা কথা।

আপনাদের পরিবার সম্পর্কে কিছু বলুন!

স্টেফিনি - যতটা জানি বলছি। ঠাকুরদার বাবা রাশিয়া থেকে এসেছিলেন, রাশিয়ান সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখাতেন। করেনটাইন ক্যাম্পে ছিলেন, আমরা এখানে নিজেদের মতো থাকি।

আমার প্রপিতামহ ছিলেন রাশিয়ান, এখানে ভারতে এসে তিনি এক পর্তুগিজকে মহিলাকে বিয়ে করেন গার্টহুড সালভাডোরকে। তাঁদের সন্তান আমার ঠাকুমা নাতালিয়া। ঠাকুমা এক কাশ্মীরি মুসলিমকে বিয়ে করেন। তিনিই আমার ঠাকুরদা। আমার ঠাকুরদাও কিন্তু করেনটাইন ক্যাম্পে ছিলেন।

কী নাম আপনার মায়ের আর ঠাকুরদার?

স্টেফিনি - নামটা বলতে পারব না।

কেন?

স্টেফিনি - আসলে আমার মা এসব পছন্দ করেন না। তিনি রাগ করেন। ভয় পান, বুঝতেই পারছ চারদিকের যা অবস্থা। পাড়ার লোক বলাবলি করবে। তুমি আমার গ্রেট গ্র্যান্ড মম আর গ্রেট গ্র্যাণ্ড ফাদারের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো আমি বলতে পারব। তাকে আমি দেখছি। ৬ ফুটের উপর লম্বা, নীল চোখ, রিয়েল হাঙ্ক বলতে যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন।

কী করেন আপনি?

স্টেফিনি - আমি লন্ডনে একটা নার্সিং হোমের নার্স। বছরের এই সময়টা এখানে চলে আসি গ্র্যানির সঙ্গে কাটাতে। (এর মধ্যেই বো ব্যারাক ঘুরতে আসা কেউ কেউ খোঁজ পেয়ে আসছেন, ঘরে তৈরি রেড ওয়াইন কিনতে। বোতলের পর বোতল নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা, সঙ্গে নাতালিয়ার তৈরি কেক)।

আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন। মানে আপনার মায়ের দিকের ইতিহাস কী?

স্টেফিনি - আমার মা একজন চাইনিজকে বিয়ে করেছিলেন। বাবার নাম জিজ্ঞাসা করো না। মা রাগ করবে। আমি তাদের সন্তান। বিয়ে করিনি, করতেও চাই না, এই বেশ ভালো আছি, নিজের জীবনকে আমি উপভোগ করি। খামোকা বিয়ে, সন্তান এসবে আমার বিশ্বাস নেই।

এবার নাতালিয়াকে প্রশ্ন করি কিছু। কেমন লাগে কলকাতা?

নাতালিয়া - ভালো, আগে আরো ভালো ছিল। এখন আর তেমন নেই। আমাদের সময়ে মানে ছেলেবেলার কলকাতার সঙ্গে এই কলকাতাকে মেলাতে পারি না। কীসব দিন ছিল, আমাদের কত বাঙালি বন্ধু ছিল জান, তারা ছিল উদার। তোমাদের এক পোয়েট অনেকবার আসত আমার বাড়িতে আড্ডা দিতে। কি নাম যেনো, শক্তি শক্তি… হ্যাঁ মে বি চ্যাটার্জি। আমার হাবির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের বাড়িতে ওরা আড্ডা মারত, পোয়েট্রি পড়ত। দেদার খানাপিনা চলত।

স্টেফিনি - আসলে এখন মানুষ বদলে গেছে, নোংরা পলিটিক্স। যে কারণে আমি লন্ডন চলে গেছি। তোমরা যারা বো ব্যারাক দেখতে আসো এখন আর আগের মতো পাবে না। জাস্ট খাঁচাটা পড়ে আছে। চাকরি নেই। আমাদের প্রজন্ম চলে যাচ্ছে সব বিদেশে। আমি চলে গেছি, আমার বন্ধু বান্ধবও কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ কানাডা, কেউ ইউএসএতে চলে গেছে।

কেন এমন বলছেন?

স্টেফিনি - আসলে বো ব্যারাকের সেই প্রাণটা চলে গেছে। নেই আর, নানান মানুষ আসত, সারা বছর উৎসব পার্টি হইহুল্লোড়। এখন সেসব কোথায়? টাকা নেই, আমাদের বয়স্করা এখানে কোনোমতে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন, ধরে রাখার চেষ্টা করছেন আমাদের ঐতিহ্য। এই যে দেখছ ক্রিসমাসের উৎসব চলছে, এসব কিছুই না, আগে রাস্তা জুড়ে ডান্স হতো, দেদার খানাপিনা চলত, কত নাচ কত গান আনন্দ। কলকাতার ভেতর যে প্রাণটা ছিল, হারিয়ে যাচ্ছে সেটা।

ফিরতে চান না কলকাতায়?

স্টেফিনি - চাই তো, কিন্তু ফিরে করব কী? এখন তো আবার কাগজপত্র দেখতে চাইছে, আছে নাকি কিছু? দেখাব কোথা থেকে? তবে কলকাতার আমার ছেলেবেলা ভুলতে পারব না কোনোদিন। জানো আমাদের এখানে একটা চাইনিজ স্কুল আছে, আগে কত স্টুডেন্ট হত, এখন মেরে কেটে ১০-১২ জন। পড়বে কে? চালাবে কী করে? কষ্ট হয় জানো।

কথা বলতে বলতেই স্টেফিনির মা চলে আসে। ফলে নাতালিয়া আর স্টেফিনির মুখ বন্ধ হয়ে যায়। উঠে পড়ি ওয়াইন আর কেক কিনে। কথা বলতে বলতে স্টেফিনি আর নাতালিয়া দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। ফেরার সময় ৭৯ বছরের তরুণী নাতালিয়া বলে ইউ নো, আই রিয়েলি ওয়ান্ট ব্যাক দো’জ ডেস, দ্যাট ওল্ড ক্যালকাটা, দ্য রিয়েল ক্যালকাটা, গড নো’জ কলকাতা ফিরবে কিনা তার পুরোনো মেজাজে। চলে আসতে আসতে মাথার ভেতর কে জানি গুনগুন করে ওঠে, “If you miss the train I’m on /You will know that I am gone/ You can hear the whistle blow/A hundred miles…”

More From Author See More