চারিদিকে রুক্ষ, শুষ্ক জমি। পাহাড় আর পাথর ঘিরে রেখেছে গোটা তল্লাট। তার ভেতর থেকেই দেখা যাচ্ছে সবুজের চিহ্ন। সেসবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরও কিছু জিনিস। কিছু ভাঙাচোরা স্থাপত্য— কোনোটার ছাদ ধসে পড়েছে, আবার কোনোটার অনেকটাই ভেঙে মিশে গেছে আশেপাশের পাথরের সঙ্গে। এভাবেই তুরস্কের আনি শহরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে ১০০১টি গির্জা। সেইসঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস আর তার মানুষগুলোর কথা।
এখনকার ‘ভূতুড়ে’ আনি শহরের রূপ দেখে কল্পনা করা যাবে না পুরনো সেই দিনের কথা। তার জন্য ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হবে। পঞ্চম শতকে প্রথম এই শহরের নাম শোনা যায় আর্মেনিয়ান ইতিহাসে। সেখানকার কামসারাখান শাসকদের আমল থেকে এই শহরের শ্রীবৃদ্ধির শুরু। সিল্ক রোডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর আনি তখন শিক্ষা, সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ ছিল। ৯৬১ থেকে ১০৪৫ খ্রিস্টাব্দ— এই সময় আনি’র প্রতিপত্তি সবচেয়ে বেশি ছিল। আর্মেনিয়ান বাগরাটিড রাজাদের আমলে সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছয় এই শহর। তাঁদের রাজা তৃতীয় আশোটের সময় এই শহর আর্মেনিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানীও হয়েছিল। সেই সময় প্রায় এক লাখ লোকের জনবসতি ছিল আনি-তে। বাড়ি, ঘর, সুরক্ষা ব্যবস্থা সবই তৈরি হয়েছিল। জন্ম নেয় ‘সিটি অফ ফর্টি গেটস’, পরে যাকে ‘সিটি অফ আ থাউসেন্ড অ্যান্ড ওয়ান চার্চেস’ হিসেবেও মনে রাখবে ইতিহাস।
সময়ের অভিঘাত বড়ো কঠিন। যখন মনে হয়, সমস্তটা ঠিকঠাক যাচ্ছে, তখনই ধ্বংসের মুহূর্ত আসে। ১০৬৪ সাল থেকে তুরস্কের সমৃদ্ধির আনি শহরের পতন শুরু হয়। সেলজুক আর্মির একটা বড়ো দল শহর আক্রমণ করে। গোটা শহর ঘিরে ফেলে; তারপর শুরু করে হত্যালীলা। সেই যে আক্রমণ শুরু হল, তা জারি থাকল আরও কয়েক শতাব্দী ধরে। কুর্দ, পার্সি, মোঙ্গলদের হাতে বারবার ধ্বংসের মুখে পড়ে এই শহর। বাসিন্দারাও ব্যাতিব্যস্ত। শেষ পর্যন্ত আর পারলেন না তাঁরা। ১৭৩৫ সালে আনি’র শেষ বাসিন্দারা শহর ছাড়েন। তারপর থেকে, এটি হয়ে যায় পরিত্যক্ত শহর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার আনিতে ফিরে এসেছিল লোকেরা। সেটা অবশ্য ক্ষণিকের জন্য, সেনাদের বসতি হিসেবে। প্রায় হাজার বছরের পুরনো এই শহরটি আজও একইভাবে রয়ে গেছে তুরস্কে। সময় আর ইতিহাস শুধু গভীর ক্ষত তৈরি করেছে সেখানে। এককালের সমৃদ্ধ শহর আজ শূন্য, খাঁ খাঁ করছে। যে এক হাজার এক গির্জার কথা ইতিহাসে লেখা আছে, সেগুলোও ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। পাথুরে এলাকায়, এভাবেই নিজের মন খারাপ নিয়ে বসে আছে আনি। অপেক্ষা, পাহাড়ের সঙ্গে মিশে যাওয়ার…