বৃত্তাকার ভূমি বিশিষ্ট শঙ্কু আকৃতির একটি বাড়ি। অনেকটা হেলিকপ্টারের ডানার দলে তার মাথার উপর বসানো একটি ধাতব কাঠামো। যা বাড়ির অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরতে পারে ৩৬০ ডিগ্রি। আবার এই বিশেষ কাঠামোটির মধ্যেই বসার জায়গা রয়েছে মানুষের। তবে কি এটি কোনো বিশেষ ধরনের নাগরদোলা?
না, তেমনটা নয়। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও বাড়ির মাথায় লাগানো হয়নি এই বিশেষ পাখাটিকে। বরং, সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্যই তৈরি হয়েছে এই ঘূর্ণায়মান কাঠামো। শুনে একটু অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। তবে শরীরে ভিটামিনের পরিমাণ বাড়াতে, বহু মানুষ প্রতিদিন গ্যাঁটের কড়ি খরচ করেই চড়তেন ‘রোটেটিং সোলারিয়াম’-খ্যাত (Rotating Solarium) এই আনুভূমিক নাগরদোলায়। তাও আবার চিকিৎসকদের পরামর্শে।
এই গল্পের শুরু উনিশ শতকের শেষের দিকে। ইউরোপের একাধিক বিজ্ঞানীর গবেষণায় উঠে আসে সূর্যালোক স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। একদিকে যেমন হাড় মজবুত হয় সূর্যালোকের উপস্থিতিতে তেমনই উপকৃত হয় ত্বক। সারে যক্ষ্মার মতো রোগ। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে সূর্যের আলো। অবশ্য এর কারণ ঠিক কী, তা তখনও পর্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল না গবেষকদের কাছে। তবে বিশ শতকের গোড়া থেকেই এ-ধরনের রোগের ক্ষেত্রে সূর্যস্নান বা হেলিওথেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দিতেন গবেষকরা।
এর দু-দশকের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে আবিষ্কৃত হয় ভিটামিন ডি। পৃথক পৃথকভাবে এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চার গবেষক— ম্যাককালাম, মেলানবাই, স্টিনবক এবং হার্ট। তবে ভিটামিন ডি-এর সঙ্গে সূর্যালোক রাসায়নিকভাবে কীভাবে সম্পর্কিত— তা প্রকাশ্যে আনেন প্যারিস ইনস্টিটিউট অফ অ্যাক্টিনোলজি-র অধ্যাপক ডাঃ জিন সাইদম্যান (Jean Saidman)। রোমানিয়ান এই গবেষকই প্রথম প্রমাণ করে দেখান সৌরশক্তি এবং উচ্চ-শক্তির আলো রাসায়নিকভাবে দেহের মধ্যে বিশেষ কিছু পদার্থ তৈরি করে। যা রিকেট, যক্ষ্মা ও অন্যান্য রোগের প্রতিকার করতে সক্ষম। পাশাপাশি তাঁর গবেষণায় এও উঠে আসে মাত্রাতিরিক্ত সূর্যালোকের প্রভাবে অনেকক্ষেত্রে হিতে বিপরীতও হতে পারে রোগীর ক্ষেত্রে। তবে উপায়?
এই সমস্যার সমাধান করতেই ঘূর্ণায়মান সোলারিয়ামের নকশা তৈরি করেন তিনি। যা সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই অভিমুখ পরিবর্তন করতে থাকে। ফলে ঘড়ি মেনে নির্দিষ্ট সময় এই সোলারিয়ামে চাপলেই পর্যাপ্ত পরিমাণ রৌদ্রস্নান সারতে পারে মানুষ। তাতে বাড়তি আশঙ্কার কিছু থাকে না। ১৯২৯ সাল। আশ্চর্য এই পরিকাঠামোটির জন্য পেটেন্টও আদায় করেছিলেন রোমানিয়ান গবেষক।
এর প্রায় এক বছরের মধ্যেই ফরাসি আল্পসে অবস্থিত আইক্স-লেস-বেইন্স শহরে গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম সোলারিয়াম। নেপথ্যে স্থপতি আন্দ্রে ফার্দে। অবশ্য আন্দ্রে বেশ কিছু বদল এনেছিলেন সাইদম্যানের তৈরি নকশায়। মূল ভবনটির কেন্দ্রে বৃত্তাকার একটি পরিকাঠামো নির্মাণ করেন আন্দ্রে। সেখানেই স্থাপিত হয় গবেষণাগার এবং পরীক্ষণকেন্দ্র। যার ঠিক মাঝখানে ছিল সিঁড়ি এবং লিফটের মাধ্যমে মূল সোলারিয়ামে যাওয়ার বন্দোবস্ত। অন্যদিকে ২৫ মিটার দীর্ঘ ও ৬ মিটার চওড়া আনুভূমিক ধাতব ডানার ঠিক মাঝখানে ছিল মনিটারিং এবং কন্ট্রোল রুম। সবমিলিয়ে এই সোলারিয়ামের শুধুমাত্র ঘূর্ণায়মান অংশটির ওজনই ছিল ৮০ টন।
সোলারিয়ামটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে, রোগীদের গায়ে সরাসরি লম্বভাবে আপতিত হয় সূর্যালোক। সঙ্গে কেবিনে অবস্থিত প্রতিটি বিছানাও স্থাপন করা হয়েছিল খানিক কাত করে। তাছাড়াও গোটা কেবিনটিকে ঢেকে ফেলা হয়েছিল নিকেল অক্সাইড এবং কোবাল্ট গ্লাসের আস্তরণে। সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মিকে বাধা দিতেই এই বন্দোবস্ত।
উনিশ শতকে সাইদম্যানের এই সোলারিয়াম রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফ্রান্সে। দূরদূরান্ত থেকে বেশ মোটা টাকা খরচ করে সেখানে রৌদ্রস্নান করতে আসতেন বাত, ডার্মাটাইটিস, যক্ষ্মা, রিকেট এবং ক্যানসারের রোগীরা। এমনকি এই সোলারিয়াম এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে পরবর্তী চার বছরের মধ্যে আরও দুটি সোলারিয়াম তৈরি করতে হয় সাইদম্যানকে। একটি ছিল ফ্রান্সের ভ্যালারিসে, অন্যটি ভারতে। হ্যাঁ, পশ্চিম ভারের গুজরাটের জামনগরেও ছড়িয়ে পড়েছিল সাইদম্যানের ব্যবসার পসার। মূলত ধনী, অভিজাত পরিবারের ভারতীয় এবং সাহেবরাই ছিলেন সেখানকার দৈনন্দিনের গ্রাহক। পরবর্তীতে এই সোলারিয়াম হয়ে ওঠে রঞ্জিত ইনস্টিটিউট অফ পলি-রেডিও থেরাপির অংশ। সোলারিয়ামটির নামকরণ করা হয় মহারাজ জাম রঞ্জিত সিংহের নামে। ফ্রান্সের দুটি সোলারিয়াম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে গেলেও, আজও গুজরাটের সোলারিয়ামটি অব্যবহৃত অবস্থায় টিকে রয়েছে সাইদম্যানের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে। এমনকি এ-দেশ এবং এশিয়ারও একমাত্র সোলারিয়াম এটিই…
Powered by Froala Editor