সময়টা ২০০৩ সাল। কিছুদিন হল, আমেরিকার মানুষের কাছে এসেছে এক নতুন ধরনের জিনিস। যার নাম স্যোশাল মিডিয়া। আজকের অতি পরিচিত এই শব্দটি সেদিন ছিল একেবারে আনকোরা। আর এই নতুন ধারাটির সঙ্গে আমেরিকাবাসীর পরিচয় ঘটিয়েছিল ফ্রেন্ডস্টার নামের একটি ওয়েবসাইট। তবে সে ওয়েবসাইট একেবারেই কাঁচা হাতে তৈরি। তারই জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। এই সময় ই-ইউনিভার্স কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন, তাঁরাই বা এমন একটা ওয়েবসাইট বানাতে পারবেন না কেন? এভাবেই জন্ম নিল ‘মাইস্পেস’ (MySpace)। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বড়ো ধরনের সামাজিক মাধ্যম।
ই-ইউনিভার্স কোম্পানির কর্মচারীদের কথা শুনে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন কোম্পানির সিইও ব্র্যাড গ্রিনস্প্যান। তবে নিজে এই উদ্যোগের দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন না। কোম্পানির এক কর্মচারী, ক্রিস ডিউলফ হলেন মাইস্পেসের সিইও। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে তৈরি একেবারে পুরোদস্তুর এক সামাজিক মাধ্যম। তেমনই সাজানো তার ইন্টারফেস। দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়ল এই ওয়েবসাইট। ডিউলফ অবশ্য প্রথমে ভেবেছিলেন, এই ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়ে কিছু রেজিস্ট্রেশন মূল্য রাখবেন। কিন্তু গ্রিনস্প্যান তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, এই ধরনের উদ্যোগ প্রত্যেক মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়াটাই জরুরি। ফলে বিনামূল্যেই অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব হল।
ব্যবসা শুরুর ২ বছরের মধ্যে ইয়াহুর তরফ থেকে প্রস্তাব এল, তারা মাইস্পেস কিনে নিতে চায়। ই-ইউনিভার্স কোম্পানির ব্যবসা তখনও তেমন বেড়ে ওঠেনি। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ডিউলফ। তবে সেই বছরই মার্কিন সংবাদ সংস্থা ‘নিউজ কর্পোরেশন’-এর কাছে বিক্রি হয়ে যায় মাইস্পেস। অবশ্য ডিউলফ যুক্তি দিয়েছিলেন, এক্ষেত্রে কারিগরি সংক্রান্ত সমস্ত নিয়ন্ত্রণই থাকবে তাঁদের হাতে। কার্যত এই পরিকল্পনা সফলই হয়েছিল। ২০০৫ সাল মাইস্পেসের চাহিদা চরমে উঠল। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে দেখা যায় দৈনিক নতুন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ। আর ২০০৬ সালের শেষের দিকে সংখ্যাটা পৌঁছেছিল সাড়ে তিন লক্ষে। ২০০৭ সালে নিয়েলসন সংস্থার পরিসংখ্যান জানায়, গুগল বা ইয়াহুর মতো ওয়েবসাইটের চেয়েও মাইস্পেসের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি।
তবে এর মধ্যেই বাজারে এসে গিয়েছে এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী। ২০০৫ সালে মার্ক জুকারবার্গ ও তাঁর বন্ধুরা মিলে তৈরি করে ফেলেছেন ফেসবুক। তবে একসময় জুকারবার্গ নিজেই এসেছিলেন মাইস্পেসের দপ্তরে। তিনি তাঁর তৈরি ফেসবুক বিক্রি করে দিতে চান মাইস্পেসের কাছে। এদিকে মাইস্পেস তখন সাফল্যের শিখরে। তার গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমেরিকার বাইরে ইউরোপ এবং এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যবসা। ২০০৯ সালে ভারতেও ব্যবসা শুরু করেছে মাইস্পেস। এত বড়ো জনসংখ্যার দেশ স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসার একটা বড়ো ক্ষেত্র। তাই জুকারবার্গের প্রস্তাব হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিয়েছিল মাইস্পেস।
তবে সেই থেকেই শেষের শুরু হল। ২০০৮ সালের মধ্যেই আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল ফেসবুক। মাইস্পেস মূলত বিভিন্ন ধরনের ফাইল আর্কাইভ নিয়েই কাজ করত। সেখানে মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জায়গা ছিল কম। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাই অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল ফেসবুক। আর একবার আমেরিকার জায়গা দখল করে নিতে পারলেই পৃথিবীজয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। কার্যত হলও তাই। ইউরোপ এবং এশিয়াজুড়ে ব্যবসা শুরু করেও তা ধরে রাখতে পারল না মাইস্পেস। ২০০৯ সাল থেকেই শুরু হল তার পতন। এখন মাইস্পেস ব্যবহারকারীর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৭-৮ মিলিয়নে।
এরপর ১২ বছর কেটে গিয়েছে। এখনও সামাজিক মাধ্যমের বাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ফেসবুক। ঠিক যেমন ১২ বছর আগে ছিল মাইস্পেস। তবে বেশ কিছু পরিসংখ্যান বলছে, ফেসবুকের বাজারও এবার পড়ে আসছে। আর এবারেও এই পতনের ইঙ্গিত দিচ্ছে আমেরিকার তরুণ প্রজন্ম। তাঁদের কাছে ফেসবুকের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে স্ন্যাপচ্যাট বা টেলিগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলি। এভাবেই হয়তো একটার পর একটা সময় পেরিয়ে যেতে থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে মানুষের রুচি। আর সেই রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজারে আসবে নতুন নতুন প্রোডাক্ট। পুঁজির নিয়মেও বাজারই যে শেষ কথা বলে।
Powered by Froala Editor