রাতের অন্ধকারে, আগরপাড়ার ন্যাশানাল টোব্যাকো কোম্পানির পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল নিয়ে আসছে ১৩ বছরের কিশোর। হাজির হল বেলঘরিয়ার ৪ নং রেলগেটের সামনে। লুকিয়ে রাখল এককোণে। খানিক বাদে, বয়সে সামান্য বড় কয়েকটি ছেলে এসে নিয়ে গেল পেট্রোল। ছিটিয়ে দিল রেলগেট লাগোয়া সিগন্যালে। এরপর অগ্নিসংযোগ। অন্ধকারের মধ্যে দাউদাউ জ্বলে উঠল রেলওয়ে সিগন্যাল। এবার সরে যাওয়ার পালা। বিড়বিড় করে একবার বীজমন্ত্র উচ্চারণ করে নিল সবাই – ‘বন্দেমাতরম্’।
১৯৪২ সাল। সারা দেশে তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। সুভাষচন্দ্র বার্লিনে। গড়ে তুলছেন নিজস্ব সেনাবাহিনী। এদিকে মহাত্মা গান্ধী ডাক দিয়েছেন – ‘ইংরেজ, ভারত ছাড়ো!’ গান্ধীর ডাক ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের প্রতি কোণায়। আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তার হচ্ছেন একের পর এক সংগ্রামী।
আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগল বাংলার একটি গ্রামেও। গ্রামের নাম ‘বেলঘর’। সাহেবরা নাম দিয়েছে ‘বেলঘরিয়া’। সেই গ্রামেরই একটি প্রাচীন পরিবার ঘোষালরা। মণিলাল ঘোষাল ছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সহকর্মী। দিল্লিতে লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর আক্রমণে রাসবিহারীর সঙ্গী ছিলেন তিনি। পরে, রাসবিহারী আত্মগোপন করলে, মণিলাল ফিরে আসেন বেলঘরিয়ায়। মণিলালেরই ছেলে বিলে। ভালো নাম বিশ্বরঞ্জন। ১৩ বছর বয়সে, এই বিলেই পেট্রোল পৌঁছে দিয়েছিল দাদাদের কাছে, সিগন্যাল পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
তবে বিলে ওরফে বিশ্বরঞ্জন ঘোষালের পরিচয় এটুকু নয়। জন্ম ১৯২৯ সালের ১৪ নভেম্বর। পড়তেন সাগরদত্ত হাই স্কুলে। সে-সময় স্কুলের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদে ছিল এক ইংরেজ। ফলে ব্রিটিশ-বিরোধী কাজকর্ম বরদাস্ত করা হত না কিছুতেই। বিশ্বরঞ্জন ও সেই স্কুলেরই আরও আট পড়ুয়া – ন’জন মিলে স্কুলে ধর্মঘট চালিয়ে গিয়েছিলেন দিনের পর দিন। এই ন’জনের দলই সেদিন রাতের অন্ধকারে পুড়িয়েছিল সিগন্যাল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বেলঘরিয়ার বুকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল দলটি।
এই দলের মাথায় ছিলেন আরএসপি নেতা শিবদাস ঘোষ। তাঁরই নির্দেশে তখন বেলঘরিয়ায় একাধিক দল ঘটিয়ে চলেছে পরপর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। সবই ইংরেজদের বেকায়দায় ফেলার জন্য। কখনও টেলি-যোগাযোগের তার ছিঁড়ে দেওয়া, কখনও রেললাইন উপড়ে ফেলা। হ্যাঁ, বেলঘরিয়া থেকে আগরপাড়া যাওয়ার ১ নং রেললাইনটি সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলা হয়েছিল সে-সময়।
বিশ্বরঞ্জনদের সিগন্যাল পোড়ানোর খবর পুলিশের কানে পৌঁছোতে বেশি সময় লাগল না। সে-সময় বেলঘরিয়া ছিল বরানগর থানার অধীনে। ন’জনের মধ্যে থেকে দু’জনকে – চণ্ডীদাস রায় ও শীতল চট্টোপাধ্যায় – পুলিশ গ্রেপ্তার করে স্কুলেই। বিশ্বরঞ্জন স্কুল থেকে পালিয়ে আসেন বাড়িতে। তখন তাঁর কাছে ছিল শিবদাস ঘোষের দেওয়া পিস্তল, মেদিনীপুরের স্বাধীন তমলুকের বিভিন্ন কাগজপত্র। তড়িঘড়ি সেসব লুকিয়ে ফেলেন বিশ্বরঞ্জন।
পরদিন বাড়িতে পুলিশ আসে। বেলঘরিয়ার পাওয়ার হাউস থেকে আব্দুল লতিফ স্ট্রিট পর্যন্ত সেদিন পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ। বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কিছুই পেল না তারা। ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার দেবী রায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করলেন বিশ্বরঞ্জনকে। কিন্তু দলের বাকিদের সম্পর্কে কোনো তথ্যই বের করা গেল না। থানায় নিয়ে যাওয়ার সময়, রুখে দাঁড়ালেন বিশ্বরঞ্জনের মা। অবশেষে বয়স বিবেচনা করে, তাঁকে গৃহবন্দি করা হল। শর্ত – স্কুল থেকে একা একা বাড়ি ফিরতে হবে, রাস্তায় কারোর সঙ্গে কথা বলা যাবে না, অন্যত্র কোথাও যাওয়া যাবে না ইত্যাদি। এর অন্যথা হলেই গ্রেপ্তার।
সেদিনের ১৩ বছরের বিশ্বরঞ্জন ঘোষালই আরও সাড়ে চার বছর পর দেশ স্বাধীন হওয়ার দিন বেলঘরিয়া থেকে অন্যান্যদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন বেলেঘাটায়। মহাত্মা গান্ধী তখন সেখানে। উৎসবের পরিবেশ চারদিকে। যে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সদ্য কৈশোরে, তা সফল হওয়ার দিনে মহাত্মা গান্ধীর সংস্পর্শ পাওয়ার ইচ্ছেটুকু ছাড়তে চাননি তিনি।
তবে এখানেই শেষ নয় বিশ্বরঞ্জন ঘোষালের জীবনকাহিনী। পরবর্তীকালে কলেজে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, আঞ্চলিক কংগ্রেসে নেতৃত্ব দেওয়া, সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে সাফল্য – তাঁর জীবনে ঘটনার অভাব নেই। বেলঘরিয়ার রথতলায় প্রাচীন রথযাত্রা ও রথের মেলার ইতিহাস জড়িয়ে তাঁর পরিবারের সঙ্গেই। সে-দায়িত্বও পালন করেছেন দিনের পর দিন। ১৯৪৫ সালে, দাদা রাধিকারঞ্জন ঘোষাল ও জীবনকৃষ্ণ মৌলিক ‘ছাত্রমঙ্গল সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করলে, সমিতির অন্যতম প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বরঞ্জন।
স্বাধীনতা দিবসের ঠিক পরের দিন, ১৬ আগস্ট ২০১৯-এ প্রয়াত হলেন তিনি। নব্বই বছর বয়েসে। শেষ চারবছর যথেষ্ট কাছ থেকে দেখেছি তাঁকে। অফুরন্ত স্নেহ ও সাহায্য পেয়েছি তাঁর। দেখেছি, বার্ধক্য ও শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও কর্মঠ ছিলেন যথেষ্ট। সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে আদালতে যেতেন প্রায়ই। ছাত্রমঙ্গল সমিতির অনুষ্ঠান হোক কিংবা রথযাত্রার আয়োজন – অশীতিপর বয়সেও সব জায়গায় উপস্থিত তিনি।
বেলঘরিয়ার ঘোষালরা একসময় জমিদার ছিলেন। সে-বংশেরই প্রবীণতম পুরুষ বিশ্বরঞ্জন। অফুরন্ত তথ্য ও ইতিহাসের ভাণ্ডার ছিল তাঁর কাছে। চিরকালের ডাকাবুকো এই মানুষটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন গতবছর স্ত্রী-র মৃত্যুর পরেই। দু’দিন আগে, চলে গেলেন নিজেও। সঙ্গে নিয়ে গেলেন বেলঘরিয়ার ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।
মাঝেমাঝে মনে হয়, ১৩ বছর বয়সে যে-কিশোর ঝাঁপ দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে, জীবনের শেষ পর্যায়ে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম – শুধুমাত্র এ-কথা ভেবেই আজীবন গর্ব অনুভব করতে পারি আমি। বিপ্লবীর কথা লিখতে পারার গর্ব। তাঁর স্নেহ পাওয়ার গর্ব।
তিনি নেই। শূন্যতা রইল। সামান্য শব্দ ছাড়া, আর কী দিয়েই বা ভরাট করব তা!