খাস কলকাতায় ভণ্ড সাধুর মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন ম্যাজিশিয়ান রাজা বোস

সময়টা গত শতাব্দীর শুরুর দিক। কলকাতার বিডন স্ট্রিট। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন স্যুট-বুট পরা এক বাঙালি। তবে আদব-কায়দায় একেবারে বিদেশি ভাবভঙ্গি তাঁর। হঠাৎ এক লম্বা-চওড়া, জটাধারী, কৌপিন পরিহিত সাধু হাজির তাঁর সামনে। সারা গায়ে ভস্মমাখা। বাঙালি ভদ্রলোকটির পথ আটকে দাঁড়ালেন সেই সাধু। কিছু বোঝার আগেই সাধু বললেন, ‘বেটা, তেরা ভালা হোগা। লে বেটা সিগরেট পি লে।’ কথা শেষ হওয়া মাত্রই, হাওয়া থেকে একটি সিগারেট বার করে এগিয়ে দিলেন সেই সাধু।

—বেটা, তেরা বরাত বহুত আচ্ছা হ্যায়। তেরা যো খারাব থা, আভি ম্যায় ঠিক কর দেতা হুঁ...

কথা শেষ করে নিজের দাড়ির ভিতর হাত ঢুকিয়ে সাধুজি বের করে আনলেন কয়েক ফোঁটা দুধ। তারপর তা রাস্তায় ফেলে দিয়ে ইঙ্গিত দিলেন আসন্ন বিপদমুক্তির। এমন আশ্চর্য ঘটনায় রীতিমতো চমকে যাওয়ারই কথা সকলের। অবাক হওয়ার কথা সাধুজির ক্ষমতায়। ভদ্রলোক কিন্তু বেশ খানিকটা উদাসীন হয়েই তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। সাধুজি ভাবলেন তাঁর শিকার টোপ গিলেছে। এবার পালা উল্টোদিক থেকে কিছু অর্থ আদায় করার। পথ ছাড়লেন না তিনি। 

তবে অবাক করার পর্ব যে তখনও শেষ হয়নি, তা বুঝতে পারেননি সাধুজি নিজেও। বরং প্রাথমিকভাবে খানিকটা লাভবান হওয়ারই কথা ভেবেছিলেন ভদ্রলোকের কথায়, ‘সাধুজি তুমি সত্যি সিদ্ধপুরুষ আছো।’ এবার বল্ ওই সাহেবি ভদ্রলোকের কোর্টে। নাক থেকে, কনুই থেকে, জুতোর তলা থেকে এমনকি সাধুজির দাড়ি থেকেও ইচ্ছে মত টাকা বার করতে লাগলেন তিনি। চোখের সামনেই একটি টাকা বা কয়েন বদলে গেল দুটি কয়েনে। ভদ্রলোকের এই কাণ্ডকারখানা দেখে রীতিমত চমকে গেলেন সাধুজি। এ যেন সাক্ষাৎ ভূতের কাছে রামনামের মতোই। অবস্থা বেগতিক বুঝে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে হাঁটা লাগালেন সেই ভণ্ড সাধু।

এই সাহেবিয়ানার ভদ্রলোকটি আর কেউ নন, বিখ্যাত জাদুকর রাজা বোস। সাধারণের কাছে তাঁর জশ, খ্যাতি, পরিচয় এই নামেই। তবে তাঁর আসল নাম ছিল রিপেন বোস। কলকাতা, অবিভক্ত বাংলা, ভারত ছাড়িয়েও তাঁর নাম-ডাকের পরিধি ছিল বিলেত অবধি বিস্তৃত।

জন্ম ১৮৮৬ সালে। কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতেই বেড়ে ওঠা। তবে ১৮ বছর বয়সেই বিদেশে পাড়ি দেন রাজা বোস। তখন জাদুবিদ্যা পছন্দের বিষয় হলেও পেশা হয়ে ওঠেনি তাঁর। উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ডে গিয়ে শিখবেন চামড়ার কাজ। ফিরে এসে ব্যবসা শুরু করবেন কলকাতায়। সেই মত শুরুও করলেন প্রশিক্ষণ নেওয়া। অবসর সময়ে বিলেতের মাটিতে সময় কাটাতে গিয়েই একদিন ভিড়লেন জাদুর ঠেকে। মঞ্চে জাদুর নানান খেলা দেখে ফিরে পেলেন জাদুবিদ্যার হারানো উদ্যম। পাল্টে গেল তাঁর পাখির চোখ। এ কৌশল তাঁকে আয়ত্ত করতেই হবে। সেখানকার কিছু জাদুকরের থেকেই শিখলেন বেশ কিছু হাত সাফাইয়ের খেলা। শেষমেশ একদিন জাদু এজেন্টদের মারফতে পরীক্ষা দিলেন মঞ্চে। মঞ্চস্থও করলেন নানান ম্যাজিকের কৌশল। সাবাসি কোড়ালেন অনেকের থেকেই। তারপর যত দিন গেছে, জাদুবিদ্যায় হাত পাকিয়েছেন তিনি। উদ্ভাবন করেছেন আরো নতুন নতুন কৌশল। যা সেই সময় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

আরও পড়ুন
‘ফাইনালি যখন কাজটা আমিই করছি, আমিই আবহ সঙ্গীত রচনা করি’; সুরের জাদুর সেই শুরু

ইংল্যান্ডে থাকাকালীনই এক যুবতী, মিস হাইডির প্রেমে পড়েন রাজা বোস। পরবর্তীকালে তাঁকেই বিয়ে করেন তিনি। কলকাতায় ফিরলেন বিংশ শতকের একের দশকে। উত্তর কলকাতার মায়ামাখা পরিবেশে গড়লেন ছোট্ট সংসার। নতুন বাড়ি করলেন ২২ নং বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে। সে বাড়ি রয়েছে আজও। ফলকে খোদাই করে লেখা ‘অফ ব্রিটিশ স্টেজ ফেম, রাজা বোস, ম্যাজিশিয়ান এন্ড সাইকিক’। 

কলকাতায় ফিরে জাদুর খেলা দেখানোর সুযোগ পেতে অসুবিধা হল না রাজা বোসের। ১৯১৮ সালে হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারে অংশ নিলেন নাটকে। নাটকের মধ্যেই ঝলসে উঠত তাঁর জাদুবিদ্যা। মঞ্চস্থ করেছিলেন ফুল্লরা, বিদ্রোহিণীর মতো নাটক। ফুল্লরা-তে সুন্দরী রমণীকে মুহূর্তে লোকচক্ষুর সামনেই পরিণত করতেন দশভুজায়।

পরবর্তীকালে এই ধরণের কাজ আরও করেছেন তিনি। ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে তাঁর মায়াজাল। ১৯২২ সালে চৌরঙ্গী অঞ্চলের কোহিনুর রঙ্গমঞ্চে (যার আর অস্তিত্ব নেই আজ) শুরু করলেন খেলা দেখানো। নিজস্ব কায়দায়, গল্পের ছলে মঞ্চস্থ করলেন বিভিন্ন এসকেপ গেম। শুধু ম্যাজিক নয় বরং তাঁর উপস্থাপনার ধরণ, কায়দাতেও আকর্ষিত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। জনপ্রিয় ছিল রিটার্ন অফ দ্য সি, সুন্দরীর প্রত্যাবর্তন, ভাল্লুক ও শিকারির খেলা। মঞ্চে সহযোগিতা করতেন তাঁর স্ত্রী মিস হাইডিও। এছাড়াও তাঁর ছোটখাটো হাত সাফাইয়ের খেলা নজর কেড়েছিল দর্শকদের। রুমালে আগুন জ্বালিয়ে সেখান থেকে বের করে আনতেন ফুলের তোড়া। সেখান থেকে ফিতে, পুতুল প্রভৃতি জিনিস। এছাড়াও শূন্য থেকে সিগারেট, কয়েন, টাকার নোট বের করে আনার মত খেলায় তাঁর নিখুঁত কৌশল অবাক করত মানুষকে। জানতেন হরবোলা এবং ভেন্ট্রিলোকুইজম-ও।

আরও পড়ুন
অস্ট্রেলিয়ায় প্রাচীন গুহাচিত্রের সন্ধান, ফুটে উঠেছে জাদুবিশ্বাস

তবে শুধু ম্যাজিক দেখানোই নয়। একটা সময় কলকাতার সমস্ত জাদুকরদের একত্রিত করতে ভূমিকাও নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩১ সালে ১৫ নভেম্বর কলকাতায় প্রথমবারের জন্য আয়োজিত হল একটি ম্যাজিকের মেলা। বউবাজার স্ট্রিটের চোরাবাজার অঞ্চলে আয়োজিত সেই স্বদেশি মেলার নাম ঠিক করা হল ‘ম্যাজিকের কুম্ভমেলা’। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী। মেলা পরিচালনার জন্য তিনি দ্বারস্থ হলেন রাজা বোসের কাছে। তাঁর আহ্বানে সেই মেলায় জাদু দেখালেন সেকালের বিখ্যাত যাদুকররা। ছিলেন অমর গাঙ্গুলী, প্রফেসর রেনন, এস মজুমদার, জি.বি. ধর, গীতা কুমার, নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ। বিশেষ অতিথি হিসাবে এসেছিলেন প্রখ্যাত জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী।

তবে কলকাতায় নাম, জশ, খ্যাতি তাঁর সমগ্র মায়াজীবনের কাছে সামান্যই। কারণ তিনি বেশিরভাগ সময়ই বিদেশে খেলা দেখিয়ে বেড়িয়েছেন। ঘুরেছেন ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, বার্মা, মালয় এবং সর্বোপরি ইংল্যান্ড তো বটেই। বিখ্যাত জাদুকর পি.সি. সরকারের আগে তিনিই বাঙালি ম্যাজিশিয়ান হিসাবে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন বিদেশের মাটিতে। গ্রেট নিকোলা, চ্যাং লিং শু, কাটার দি গ্রেটের মত খ্যাতনামা বিদেশি জাদুকররা কলকাতায় এসে কোহিনুর রঙ্গমঞ্চে খেলা দেখিয়েছিলেন। তাঁদের মত একই মঞ্চে খেলাও দেখিয়েছিলেন রাজা বোস।

তাঁর জাদুর মতই বৈচিত্র্যময় ছিল তাঁর জীবন। একটা সময় জাদুর পেশা ছেড়ে সাধারণ জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন রাজা বোস। শেষ জীবনে চলে গিয়েছিলেন গিরিডির বাড়িতে। শেষের কয়েকটা বছর একাই থেকেছেন সেখানে। ব্যবসা করতেন অভ্রের। শারীরিক অসুস্থতা এবং ভারতীয় পরিবেশে মানিয়ে না নিতে পেরে তাঁর স্ত্রী চলে গিয়েছিলেন বিদেশে। ১৯৪৮ সালে গিরিডিতেই দেহ রাখেন এককালের জনপ্রিয় এই জাদুকর। সারা জীবনের স্টেজ, আলো, ফেম, মায়াজালের বাইরে একান্তেই নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে চলে যান তিনি।

আরও পড়ুন
ক্যামেরাবন্দি করেছেন গোটা পৃথিবীকেই, আজও ফুরোয়নি অটেনবোরো-র জাদু

তবে নিজের কাজ সংরক্ষণ করেননি রিপেন বোস। বই লেখাতে ছিল তাঁর প্রচণ্ড অনীহা। মনে করতেন, জাদুবিদ্যা আসলে লুকিয়ে রাখারই জিনিস। তার গোপনীয়তা প্রকাশ পেলে হারিয়ে যায় তার বিস্ময়ও। সে জন্যই বোধ হয় তাঁর উপস্থাপিত জাদুগুলির গল্প আজও অবাক করে মানুষকে। তবে বাঙালির থেকে শ্রদ্ধা, ভালবাসা পাওয়ার পরেও; নিজের এই প্রকাশ্যে না আসাই কি আরেকদিক থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে তাঁর মুছে যাওয়ার কারণ? জানা নেই। তবে ম্যাজিকের জগতে যে কোনো বাঙালি জাদুকরই রাজা বোসকে এখনও এক ডাকেই চিনতে পারেন। মঞ্চের বাইরেও তাঁর জীবন রেখে দিয়ে গেছেন তিনি। সেই জীবনের গল্প খুলে দেখলে বিস্মিত হবেন সকলেই। মিলবে না অনেক সমীকরণই। কেবল পাঠক জড়িয়ে যাবেন অকৃত্রিম এক মায়াজালে...

অনুলিখন – শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More