কী জানি কী মনে করে সেদিন আবার গিয়ে দাঁড়ালাম বাড়িটার সামনে। দুপুরের গায়ে ইতিউতি মেঘ জমেছে। আর বাড়ির নাম ‘ভালো-বাসা’। নবনীতা চলে গিয়েছেন গত বছর এমনই নভেম্বরে। ভালো-বাসা আজ মেঘলা দুপুরটার মতোই নির্জন।
নবনীতার কথা ভাবতে বসলেই মনে পড়ে তাঁর নিজের বুনে যাওয়া গল্পগুলো। কত গুণী লোকের সঙ্গেই না তাঁর ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা। কখনো বিতণ্ডা। ভালোবাসা। আর খুব মনে পড়ছে নবনীতার প্রেমের স্মৃতিচারণ। না, ব্যক্তিগতয় জোর করে উঁকি না। সেই প্রেম উঠোনে বিছোনো রোদ্দুরের মতোই। অমল রোদ্দুর…
এই যে ব্যস্ত রাস্তা, এই পথ ধরেই একদিন অমর্ত্য সেন এসেছিলেন, গলায় লাল-রঙা টাই ঝুলিয়ে। উদ্দেশ্য নবনীতাকে কফি খাওয়াতে বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া। বাড়িতে ঢোকার আগেই নাকি একগাল হেসেছিলেন অমর্ত্য। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তরে হাসিই ফেরত দিয়েছিলেন নবনীতা। রাধারানি দেবীর নির্দেশ মতো কফির আড্ডা শেষে নবনীতাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন অমর্ত্য। তবে এই বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার শুরুয়াৎ হয়েছিল আগেই। কলেজে থাকতেই তার্কিক মহলে তাঁদের মোলাকাত। তর্কের উত্তেজিত হুঙ্কার লয় পেয়েছিল শান্তিনিকেতনের দোলপূর্ণিমার রাতে। পথে নবনীতার সঙ্গে হঠাৎ-দেখা অমর্ত্যর। বৈতালিকের গান চলছে। আর সেদিনই সব কুঁড়ি ফুটে উঠেছিল দুজনের।
এইসব স্মৃতি নবনীতাই নিজেই নানা জায়গায় বলে গিয়েছেন। বড়ো যত্ন করে লেখা প্রতিটি বাক্য। স্মৃতিসূত্রকে এমনভাবে টেনেছেন, যে তারা কিছুতেই জট পাকায়নি। ঠিক অ্যালবামের মতো একটার পর একটা ছবি। শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার দিন বৃষ্টি নেমেছিল। কলকাতায় ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার স্মৃতি নবনীতা ধরে রেখেছেন কবিতায় – “অন্ধকারে বৃষ্টি পড়েছিল / গাড়ির কাচে নৃত্যপর ছায়া/ নদীর হাওয়া হঠাৎ ছুঁয়ে দিল/ চিত্তে কাঁপে গোপন অশনায়া…”
আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় হিসেবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় শান্তি পুরস্কার পেলেন অমর্ত্য সেন
তারপর অমর্ত্যর বিলেতযাত্রা। কিছুদিন পরে নবনীতারও। টেমস নদীর ধারে নবনীতাকে বিবাহ প্রস্তাব দেন অমর্ত্য। বিলেতে শুরু হয় তাঁদের বিবাহিত জীবন। প্রায় দু-দশকের দাম্পত্যে দুজনেই নতুনভাবে চিনছেন পৃথিবীটাকে। কতশত মানুষের সঙ্গে নিত্য দেখাশোনা। শুধু কি মানুষ? পৃথিবীর নানা দেশ, নানা অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তাদের দাম্পত্যযাত্রা। বিশ্বভ্রমণ চলছে নবদম্পতির। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে যোগ দেবেন অমর্ত্য। তার আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার আটকে পড়ছেন এমন এমন শহরে, যা জুয়ার অন্যতম আড্ডা। কুণ্ঠিত অমর্ত্য বারবার টেলিফোন করছেন ডিপার্টমেন্টে। কাজে যোগ দিতে দেরি হচ্ছে তাঁর। যাতে তাঁকে জুয়াড়ি না ভাবে লোকে - এই নিয়ে বিষম চিন্তা। আর এই বার্কলেতেই নবনীতা জড়িয়ে পড়ছেন ছাত্রছাত্রীদের ফ্রি-স্পিচ আন্দোলনের সঙ্গে। সারারাত ধরে প্রতিবাদের গান গাইছেন তিনি, সমবেতভাবে। একদিন হঠাৎই তাঁরা শুনে ফেলছেন জোন বায়েজের গান। তারপর যেন আবিষ্কার করছেন এই অপূর্ব মানবীকে।
এভাবে ক্রমশ বড়ো হচ্ছিল তাঁদের দুজনের পৃথিবীটাই। কখনো একসঙ্গে আবার কখনো পৃথকভাবেই। আর এসবের মধ্যে অমর্ত্যকে নবনীতা আবিষ্কার করছেন একজন নিরলস সাধক হিসেবে। অবসর বলে নাকি তখন কিছুই নেই অমর্ত্যর জীবনে। প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন অলৌকিক কিছুকে ছোঁয়ার। অমর্ত্যর সে জীবনপণ পরিশ্রমের সাক্ষ্য দেন নবনীতা। ধারাভাষ্য শোনান। বারবার যেন আক্ষেপের সুরেই নবনীতা বলতে থাকেন অর্থনীতি তাঁর বিষয় নয়, অর্থনীতি তিনি বোঝেন না। বলতে থাকেন, তাঁরা মানুষ দুটোই বড্ড আলাদা। বলেন, অমর্ত্যর ‘সেন্স অব হিউমার’ ছিল খুব ভালো। সেটা তাদের জুড়ে-থাকার অন্যতম কারণ। আর বলেন তাঁর বিশ্বাসের কথা। ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যে। তাহলে নিশ্চয়ই বিচ্ছেদেও রয়েছে ঈশ্বরের মঙ্গলস্পর্শ। আমরা এখানে আরো গভীরে কান পাতি। কী ঝরে পড়ছে? আক্ষেপ ? দীর্ঘশ্বাস…? নাকি এক অদ্ভুত প্রশান্তি, চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থাকা?
আরও পড়ুন
যুগে-যুগে রামায়ণ লিখেছেন যে সাহসিনীরা, তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন নবনীতা
অমর্ত্য সেনের নোবেল পাওয়ার দিন সংবাদপত্রকে জানিয়েছিলেন, এই সম্মান তাঁর আরো আগে পাওয়া উচিত ছিল। লিখছেন, অমর্ত্যর হাসি যেন চিরকাল অম্লান থাকে। আর ১৯৯৮ সালের ৩রা নভেম্বর অমর্ত্য সেনের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লিখছেন দীর্ঘ প্রবন্ধ, সারারাত ধরে চলছে স্মৃতিরোমন্থন। শেষে অমর্ত্যকে বলছেন, 'Treat this article as flowers…'
একবার নয়। নবনীতা বহুবার এইসব স্মৃতির পাতা উল্টেছেন। নিজেই ফিরে ফিরে নিজের রঙিন অতীতটাকে দেখেছেন। তাঁর জীবনের অনেকগুলি পরিচ্ছেদ অতীতে আটকানো। নবনীতা সেসব থেকে বেরোতে পারেন না। আর পাঠকদেরও বেরোতে দেন না কিছুতে। হয়তো অনেক মানুষের জীবনেই এমনসব গল্পেরা থাকে। কিন্তু নবনীতার গল্পের চরিত্ররা যারা, তাদের জীবনের ভিতর আশ্চর্য এক জীয়নকাঠি লুকিয়ে আছে যেন। গল্পই, সত্যি-গল্প। হয়তো নস্টালজিয়া। কেউ কেউ বলেন, নস্টালজিয়া এই শতকের একটা রোগ। চিকিৎসাহীন রোগ। তা রোগ যদি এতই মধুর হয়, সে রোগ বাধাতে দোষ কি? তাকে ঘিরেই তো চারপাশকে নতুনভাবে দেখতে চাওয়া। শান্তিনিকেতনে অমন পূর্ণ চাঁদের মায়া আর ধরা দেয় না তেমন। তাই এই গল্পগুলো থাকুক। তারা অন্তত কিছুকাল জ্যোৎস্না ঢালতে পারবে। আমাদের প্রচণ্ড বাস্তব দুনিয়াটায় বেঁচে থাকার অবকাশ লুকিয়ে আছে নস্টালজিয়ার মধ্যেই।
আরও পড়ুন
শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন অমর্ত্য সেন, ঘোষণা জার্মান বুক ট্রেড সংস্থার
ভালো-বাসার সামনে দাঁড়ালে সেই অমলিন অতীতগুলি সিনেমার মতোই ফুটে উঠতে থাকে। ঘোর লাগে। বেরিয়ে আসতে মন চায় না।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
'আমাকে কখনোই অসুস্থ বলবে না, আমি সুস্থ আছি' - বলতেন নবনীতাদি : অংশুমান কর