দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে চাপানউতোর চলছিল কয়েকমাস ধরেই। গত মাসের ২৪ তারিখ জল্পনার অবসান করে অতর্কিতেই ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় রাশিয়া। তারপর প্রায় এক মাস ধরে চলছে যুদ্ধ। বলতে গেলে, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রই সরব হয়েছে রাশিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। আরোপ করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা। তবে তারপরেও এতটুকু বদল আসেনি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। এরই মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার ফসফরাস বোমা (Phosphorus Bomb) নিক্ষেপ নিয়ে নতুন করে দানা বাঁধছে বিতর্ক। উঠছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও।
ইউক্রেনের মানবাধিকার ন্যায়পাল লিউডামিলা ডেনিসোভা সম্প্রতি দাবি করেন ইউক্রেনের পোপান্সায় ক্রামাটোর্স্ক ফসফরাস বোমা নিক্ষেপ করে হামলা চালায় রুশ বাহিনী। হামলায় বেশ কিছু সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট শহরের মেয়রের। প্রকাশ্যে এসেছে বেশ কিছু ছবিও। যদিও এখনও পর্যন্ত এই হামলার দায় স্বীকার করেনি রাশিয়া। কিন্তু এই বিশেষ বোমা নিক্ষেপ নিয়েই কেন বাড়তি বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে গোটা বিশ্বজুড়ে? এই ফরফরাস বোমাই বা আদতে কী?
উনিশ শতকের শেষের দিক সেটা। এক আইরিস রসায়নবিদের হাতেই প্রথমবার জন্ম নিয়েছিল ফসফরাস বোমা। কার্বন ডাইসালফাইডের দ্রবণে সাদা ফসফরাস মিশিয়ে তৈরি হয়েছিল এই বোমার প্রিমিটিভ সংস্করণ। আয়ারল্যান্ডে তখন ক্রান্তিকাল। মূলত, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী ফেনিয়ানদের দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল এই বোমা। তবে সাধারণ বোমার মতো এই বোমার প্রভাব ক্ষণস্থায়ী নয়। সাধারণত, সাদা ফসফরাস অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই আগুন ধরে যায় তাতে। সম্পূর্ণ জ্বালানি অর্থাৎ ফসফরাসের বিক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত জ্বলতে থাকে এই আগুন। ফরফরাস অগ্নিশিখার উষ্ণতা প্রায় ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি হওয়ায় এই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ‘ফায়ার বোম’ বা অগ্নিবোমা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ফসফরাস। তবে শুধু অগ্নিসংযোগই নয় যুদ্ধক্ষেত্রে, এই অস্ত্র ব্যবহারের আরও বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত, এই বোমার বিষাক্ত ধোঁয়া ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে আস্ত শহরকে। ফলে, খুব সহজেই সেনাছাউনি বা আস্ত শহরকে ক্ষমতায় আনতে ব্যবহৃত হত ফসফরাস বোমা। গ্যাসমাস্ক পরিধানেও মিলত না পরিত্রাণ। গাঢ় ধোঁয়া ঝাপসা করে দিত শত্রুসেনাদের দৃষ্টি। পাশাপাশি এই বোমার বিস্ফোরণ অকেজ করে দিত বিপক্ষের সামরিক অস্ত্র।
১৯৭৭ সালে জেনেভা সম্মেলনে এই কারণগুলির জন্যই ফসফরাস বোমাকে কেমিক্যাল ওয়েপন বা রাসায়নিক অস্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। জৈবঅস্ত্রের মতোই বিশেষ আন্তর্জাতিক আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় ফসফরাস বোমা। কিন্তু তারপরেও বন্ধ হয়নি তার ব্যবহার। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব, এমনকি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ফসফরাস বোমা। এর আগে একাধিকবার এই বোমা ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দিকেও। এবার আবারও যেন সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি, মানব সভ্যতার হিংস্রতাকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে…
Powered by Froala Editor