অগ্নিগর্ভ কাজাখস্তান, গণবিক্ষোভে টালমাটাল মধ্য এশিয়ার এই দেশ

গত কয়েকদিন ধরেই ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হচ্ছিল কাজাখস্তান (Kazakhstan)। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল সে-দেশের পরিস্থিতি। দেশের জায়গায় জায়গায় আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল সরকার বিরোধী বিক্ষোভের (Anti-Government Protest) আঁচ। বিক্ষোভ দমনে গতকালই সেনাবাহিনীকে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন কাজাখ রাষ্ট্রপতি কাসিম জোমার্ত তোকায়েভ। আর সেই সংঘর্ষেই প্রাণ হারালেন ২৬ জন সশস্ত্র বিক্ষোভকারী। যদিও বেসরকারি মতে, সংখ্যাটা বেশ কয়েক গুণ। অন্যদিকে প্রাণ হারিয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর ১৮ জন সৈনিকও। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সাময়িক 'যুদ্ধবিরতি' ঘোষণা করা হলেও, অবস্থান থেকে সরছেন না বিক্ষোভকারীরা।

কিন্তু কেন এই বিক্ষোভ? আদতে খনিজ তেল এবং তরলীকৃত গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধির কারণেই সূত্রপাত এই বিক্ষোভের। কয়েকদিনে আগেই সরকার নির্ধারিত এলপিজি এবং জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করে নেয় কাজাখ প্রশাসন। তারপরই ধাপে ধাপে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে পৌঁছায় জীবাশ্ম জ্বালানির দাম। অথচ সোভিয়েতের এই সাবেক অঙ্গরাজ্যটির গর্ভেই লুকিয়ে রয়েছে বিপুল খনিজ তেলের ভাণ্ডার। তা সত্ত্বেও কেন এমন অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধি সরকারের? সেখান থেকেই ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে বিক্ষোভ। 

মঙ্গলবার থেকেই পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ লেগে ছিল বিক্ষোভকারীদের। রাজধানী শহরে মেয়রের ভবন এবং বেশ কিছু থানাতেও হামলা চালায় ক্ষিপ্র জনতা। ভাঙচুরের পর আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয় কোনো কোনো জায়গায়। পাল্টা টিয়ার গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করে পুলিশ বাহিনী। গতকাল দেশের রাষ্ট্রপতি বিক্ষোভকারীদের ‘বিদেশি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়ার পর আরও ঝাঁঝাল হয় সেই বিক্ষোভের আঁচ। পাল্টা গুলি চালানোর নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি। আহত হন ছয় শতাধিক মানুষ। প্রাণ যায় আরও ২৬ জনের। গতকাল এর পরেই ৬ মাসের জন্য তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের হাতে তুলে দেন দেশের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তারপরেও দমেনি কাজাখস্তানের বিক্ষোভ। বরং, আরও বেড়েছে তাঁর ঝাঁঝ। শেষ পর্যন্ত সেনা সাহায্য চেয়ে রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে মধ্য এশিয়ার দেশটি। সাড়া দিয়েছে রাশিয়াও। 

কিন্তু শুধুই কি মূল্যবৃদ্ধির জন্য এই মাত্রার একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন? না, এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে আরও একটি কারণ। আর সেই কারণের সন্ধানে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় তিন দশক। ১৯৯১ সাল সেটা। ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বেলারুশ, ইউক্রেন, আজারবাইজান কিংবা আরমেনিয়ার মতো স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় কাজাখস্তানও। স্বাধীন হওয়ার পর কাজাখস্তানে নির্বাচন হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু প্রার্থী ছিলেন একজনই। নুর-সুলতান নজরবায়েভ। না, দ্বিতীয় কোনো প্রার্থীকেই দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি বিপক্ষে। সেই ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা ২৭ বছর রাষ্ট্রপতির আসনে শাসন করেছেন নজরবায়েভ। তাঁর কর্মকাণ্ডও ছিল বিচিত্র। রীতিমতো ব্যক্তিপুজোর প্রচলন করেন প্রাক্তন কাজাখ রাষ্ট্রপ্রধান। নিজের নামে রাজধানীর নামকরণ থেকে শুরু করে জায়গায় জায়গায় তাঁর ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন কিংবা ‘নজরবায়েভ আরাধনা’— নাটকীয়তার অভাব ছিল না কোনো অঙ্গেই। 

আরও পড়ুন
মৃত ৫ লাখ, নিষ্ক্রিয় প্রশাসন; কোপা আমেরিকার মধ্যেই বিক্ষোভ ব্রাজিলে

এই একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধেই ক্রমশ ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে দেশের সাধারণ মানুষ। ২০১৮ সালে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক গণআন্দোলন। তারপরেই পদত্যাগ করেছিলেন নুর-সুলতান নজরবায়েভ। তবে অলিখিত এই স্বৈরতন্ত্রে ইতি পড়েনি। মসনদে বসেন তাঁরই ডান হান তথা বিশ্বস্ত সহকর্মী কাসিম তোকায়েভ। বলতে গেলে কাসিমকে সামনে রেখেই যেন দেশের কলকাঠি নাড়ছেন নজরবায়েভ। প্রশাসনিক এবং সামরিক বিভাগে এখনও শীর্ষস্থানীয় একটি পদও দখল করে রেখেছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। 

আরও পড়ুন
গণহত্যাকারী প্রেসিডেন্টের শাস্তি চাই, বিক্ষোভে উত্তাল ব্রাজিলের রাজধানী

অধিকাংশ কূটনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, কাজাখস্তানের এই বিক্ষোভ মূলত নজরবায়েভকে কেন্দ্র করেই। খনিজ তেলের মূল্যবৃদ্ধি কেবল উপলক্ষ মাত্র। তবে কাজাখস্তানের এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি অভ্যন্তরীণ না থেকে ক্রমশ হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক। সরকারের পক্ষ থেকে বিক্ষোভের জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে পশ্চিমা শক্তিগুলিকে। সেইসঙ্গে ইতিমধ্যেই জড়িয়ে পড়েছে রাশিয়া। যদিও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রকের বিবৃতিতে এখনও পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে এই বিক্ষোভকে। এখন দেখার, কোনদিকে বাঁক নেয় পরিস্থিতি…

আরও পড়ুন
নাভালনির মুক্তির দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ রাশিয়ায়, গ্রেপ্তার সহস্রাধিক

Powered by Froala Editor

Latest News See More