লম্বা বাদামি চুল। হালকা দাড়ি। নীল চোখ। মাথায় কাঁটার মুকুট।
যিশুখ্রিস্ট। আলাদা করে তাঁর পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০০ কোটি মানুষের উপাস্য তিনি। বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মের প্রবর্তক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পকে প্রভাবিত করে এসেছেন তিনি। তবে মজার বিষয় হল, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ‘ব্লু আইড বয়’। কোথাও তাঁর পরিচয় ‘জিসাস’, কোথাও ‘ইসাস’, ‘যিশু’ বা ‘জোসুয়া’ নামে পরিচিত তিনি। আবার খোদ বাইবেলের একাধিক সংস্করণে, বিশেষত নিউ টেস্টামেন্টে তাঁকে ডাকা হয়েছে ‘হোশিয়া’ নামে। কিন্তু কোনটি প্রকৃত নাম তাঁর?
প্রশ্নটা শুনে একটু ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। ভাবছেন এ-আবার কেমন প্রশ্ন। যিনিই যিশু, তিনিই তো জিসাস। ক্ষেত্র, আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ভাষার উপর ভিত্তি করেই বদলে বদলে গেছে তাঁর নাম। তবে বাহ্যিকভাবে এই প্রশ্নকে তুচ্ছ মনে হলেও, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এই প্রশ্ন। অনেকের অভিমত, ‘জেসাস’ বা ‘জিসাস’ (Jesus) নামটা ইউরোপীয়দের আরোপিত। ‘জেসাস’ বা ‘জিসাস’-এর নামে প্রার্থনা করে হলে ভুল ব্যক্তির উপাসনা করা হয়, এমনটাই মনে করেন খ্রিস্টা ধর্মাবলম্বীদের একাংশ। তাঁদের কথায়, যিশু খ্রিস্টের আসল নাম হল ‘জোশুয়া’ (Joshua)। বিশেষ করে মেসিয়ানিক ইহুদিরা এই বিশেষ তত্ত্ব বা দর্শনে বিশ্বাসী।
আজ থেকে দুশো বছর আগের কথা। এই বিতর্কের সমাধান করতেই শুরু হয়েছিল যিশুর প্রকৃত নামের অনুসন্ধান, গবেষণা। যে-গবেষণা চলছে আজও। একাধিক ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে, যিশুর নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্যুৎপত্তিগত ও ঐতিহাসিক পটভূমি। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে দেখতে গেলে ‘জিসাস’ বা ‘জেসাস’ কথাটির উৎস হল হিব্রু শব্দ ‘জোশুয়া’। যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘দ্য সন অফ নান’ অর্থাৎ সন্ন্যাসিনীর সন্তান। আবার ‘জোশুয়া’ বলতে ‘সন অফ জোসেফ’ বা জোসেফের সন্তান-ও বোঝায়। ‘ইজরায়েলের মহান নেতা’ ও ‘মুক্তির পথপ্রদর্শক’-এর অর্থও হিব্রু ভাষায় ‘জোশুয়া’। বাইবেলেও উল্লেখিত রয়েছে ‘জোশুয়া সাকসিডেড মোজেস’। অর্থাৎ, মোজেসের উত্তরসূরি যিশু। নিউ টেস্টামেন্টের কিছু জায়গায় ‘জোশুয়া’-কে লেখা হয়েছে ‘হোশেয়া’ (Hoshua) হিসাবেও। এক্ষেত্রেও অর্থ একই। তবে হিব্রু ভাষায় ‘Jehoshua’ শব্দের বিবর্তনই এই তারতম্যের কারণ। মূলত গণ-পরিযায়নের সময়ই এই বিবর্তন ঘটেছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে ‘জেসাস’ শব্দটি আদতে গ্রিক শব্দ। গ্রিক ভাষায় এই কথাটির অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘সন অ্যান্ড সার্ভেন্ট অফ গড’। অর্থাৎ ঈশ্বরের সন্তান।
আধুনিক এটিমোলজিস্ট বা ভাষাতাত্ত্বিকদের বিচারে, হিব্রু থেকে গ্রিক ভাষায় বাইবেল অনুবাদের সময়ই বদলে গিয়েছিল ‘যোশুয়া’ শব্দটি। এক্ষেত্রে নামকে প্রাধান্য না-দিয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল তার মাহাত্ম্যকে। কারণ, ততদিনে যিশু পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ঈশ্বরের সন্তান হিসাবে। তাই ‘জিসাস’ কথাটি ব্যবহার করেছিল গ্রিকরা। গ্রিক দেবতা ‘জিউস’-এর প্রভাব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এই নামকরণ নয়। আবার পরবর্তীতে ‘জিসাস’ বা ‘জেসাস’ থেকে ‘ইসাস’ কিংবা বাঙালির মুখে উচ্চারিত ‘যিশু’ এসেছে স্থানভিত্তিক উচ্চারণের ভিন্নতায়।
তবে এ তো গেল ব্যুৎপত্তির কথা। ‘জিসাস’ যে গ্রিক দেবতা ‘জিউস’ নন, এই বিতর্কের ইতি টানতেই পরবর্তীতে চালু হয়েছিল ‘জিসাস অফ নাজারেথ’ শব্দবন্ধটি। তবে বিতর্ক থেমে থাকেনি সেখানেও। ‘যোশুয়া’ নামটি কার দেওয়া, তা নিয়েই চলছে চর্চা। কারোর মতো তাঁর বাবা-মা-ই এই নাম রেখেছিলেন তাঁর। তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। প্রথম এবং দ্বিতীয় শতাব্দীর ইজরায়েলে ‘যোশুয়া’ নামটি ছিল অতি-সাধারণ একটি নাম। তবে অনেকে দাবি করেন খোদ ঈশ্বরের স্বর্গদূত এহেন নামকরণ করেছিলেন যিশুর। যিশুর নাম অনুকরণ করেই পরবর্তিতে এই নামটি প্রচলিত হয়ে ওঠে গোটা ইজরায়ালে। ঠিক যেমন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা মিললেও ‘জেসাস’ ও ‘যোশুয়া’-র দ্বন্দ্ব কাটেনি, তেমনই এই বিতর্কের ইতি পড়েনি আজও।
Powered by Froala Editor