মানব সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ নেই কোনো। জীবন বলতে গহীন অরণ্যের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছুটে চলা শুধু। কখনো প্রাণ বাঁচানোর জন্য, আবার কখনো ক্ষুধানিবারণের জন্য সংঘাত বন্যপশুদের সঙ্গে। একদিন দু’দিনের কোনো অভিযান নয়, বরং সারা এটাই স্বাভাবিক জীবন। কী মনে হচ্ছে? এডগার রেজের ‘টারজান’-এর সেই গল্প? না, যে ঘটনার কথা হচ্ছে তাতে রূপকথার ছাপ নেই এতটুকু। এই চরিত্র বাস্তবের। আর সম্প্রতি এই ‘বাস্তব টারজান’-এর সন্ধান মিলেছেন ভিয়েতনামের ক্রান্তীয় অরণ্যে।
হ্যাঁ, ‘বাস্তবের টারজান’ নামেই এখন পরিচিতি লাভ করেছেন তিনি। যদিও তাঁর আসল নাম হো ভ্যান লাং। বিগত ৪১ বছর ধরেই এই অরণ্যজীবনকে আঁকড়ে ধরেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। আর তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গল্পের সঙ্গেও বেশ মিল রয়েছে কমিকসের চরিত্রটির। আর পাঁচটা শিশুর মতো শহরেই জন্ম হয়েছিল লাং-এর। তবে দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় তাঁর স্বাভাবিক জীবন। তারপর শিশু অবস্থাতেই ঠাঁই নেওয়া অরণ্যে।
সেটা সত্তরের দশক। তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম। মার্কিন বোমারু বিমানের হানায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল তাঁর বসতভিটে। ঘটনাস্থলেই মারা যান তাঁর মা এবং দুই ভাই-বোন। কোনোক্রমে তাঁকে এবং তাঁর দাদাকে নিয়ে শহর ছেড়ে নিরিবিলি অরণ্যে পালিয়ে আসেন তাঁর বাবা হো ভ্যান থ্যান। ল্যাং কোয়াই এনগাই প্রদেশের গভীর জঙ্গলের বুকে গড়ে তোলেন ছোট্ট পাতার ছাউনি। জনবসতি, সভ্যতার কোনো আঁচই পড়ে না যে ক্রান্তীয় অরণ্যে।
লাং তখন একেবারেই শিশু। পরিপার্শ্বের হাল-হাকিকত বুঝে ওঠার জ্ঞান হয়নি তাঁর। ফলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই জীবনটাকেই স্বাভাবিক হিসাবে ভাবতে শিখেছেন লাং। আর যুদ্ধের হিংস্রতার কথা ভেবেই, সন্তানের সামনে সভ্যতার নামটুকুও উচ্চারণ করেননি তাঁর বাবা। বরং, সভ্য মানুষ দেখলেই যে পালাতে হয়, এমনটাই শেখানো হয়েছিল তাঁকে। দাদা ট্রাই-এর সঙ্গে জোট বেঁধেই লাং সংগ্রহ করে বেড়াতেন বনের ফল, মধু আর বন্য পশুর মাংস। পোশাক কিংবা বাড়ির জন্য খুঁজে আনতেন গাছের বড়ো বড়ো পাতা, শুকনো ডাল আর শিকড়।
আরও পড়ুন
প্রতিবেশীদের কাছে ‘রিয়েল লাইফ মোগলি’, সামাজিক নিগ্রহের শিকার আফ্রিকার যুবক
২০১৬ সালে প্রথম চিত্রসাংবাদিক আলভারো সেরেজোর নজরে আসে বিষয়টি। ভিয়েতনামের অরণ্যে ফটোশুট করতে গিয়েই এই অদ্ভুত পরিবারটিকে আবিষ্কার করেন তিনি। তবে কথা বলে ওঠার সুযোগ হয়নি। তার আগেই পালিয়ে যান লাং এবং তার দাদা ট্রাই। তবে ক্রমাগত চেষ্টার ফলে শেষ অবধি সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়। সামনে আসে ‘আরণ্যক’-দের গল্প।
আরও পড়ুন
গল্পের মোগলি ছিল বাস্তবেও; ভারতের ‘বুনো শিশু’-র কথাই লিখেছেন রুডইয়ার্ড কিপলিং!
সেরেজোর কথা অনুযায়ী, ৪১ বছরের জীবনে মাত্র ৫ বার সভ্য মানুষের দেখা পেয়েছিলেন লাং। এমনকি মহিলা এবং পুরুষের মধ্যে পার্থক্যটুকুও জানতেন না। বলা ভালো, নারীজাতির অস্তিত্ব সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল নন তিনি। সভ্যতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় গড়ে ওঠেনি যৌন প্রবৃত্তিও। ৪১ বছর বয়সেও ঠিক যেন অবুঝ মানবশিশু। উচিত-অনুচিত বিচার করার ক্ষমতাও তৈরি হয়নি তাঁর মধ্যে।
সম্প্রতি সেরেজোই উদ্যোগ নিয়ে নিকটবর্তী একটি গ্রামে তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। তবে অরণ্যজীবন ছেড়ে এসে শুরুতে বেশ বিপাকেই পড়েছিলেন তাঁরা। মানুষ আর যন্ত্রের কোলাহলেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল লাং-এর জীবন। সেইসঙ্গে অরণ্য ছেড়ে লোকালয়ে পুনর্বাসনের জন্য তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াল রোগেও। তবে তাঁকে নিয়েই সবথেকে আশঙ্কায় ছিলেন তাঁর পরিবার। কারণ, স্বাভাবিক বোধ তৈরি না হওয়ায় যে কোনো অঘটনই বাঁধিয়ে বসতে পারেন। তবে নতুন শহরে এসে, পরিপার্শ্বের মানুষদের সঙ্গে মিশে বেশ খানিকটা বদলে গেছেন তিনি। গড়ে উঠছে সভ্যতার সঙ্গে বন্ধুত্বও। আর তাঁর বাবা? পুনর্বাসনের আগে পর্যন্তও তিনি বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে বহু বছর আগে। অশান্তি আর রক্তক্ষরণের ট্রমা যেন শেষ বয়সেও তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তাঁকে। লাং-এর এই রোমহর্ষক অরণ্যজীবন হার মানিয়ে দিয়েছে কল্পনার আখ্যানকেও। তাই নেটিজেনদেরও উত্তেজনার অভাব নেই, বাস্তবের এই টারজানকে নিয়ে। তবে এই জনপ্রিয়তাই কিছুই আসে যায় না তাঁর। পোষ্য প্রাণীদের নিয়েই এখন নতুন বসতিতে বেশ আনন্দেই রয়েছেন তিনি…
Powered by Froala Editor