স্যুট পরে হাজিরা স্কুলে, ‘স্বাভাবিক’ ছন্দে ফিরছে ‘রিয়েল লাইফ মোগলি’

বয়স ২১ বছর। অথচ, নিজের মাতৃভাষাও বুঝতে পারে না সে। উচ্চারণ করতে পারে না কোনো শব্দ। প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও তার আচরণ শিশুসুলভ। শরীরের গঠনও খানিক ‘অদ্ভুত’। তার ওপরে, তার স্বভাব বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো। ঠিক যেন ‘দ্য জঙ্গল বুক’-এর মোগলি। হ্যাঁ, তার পরিচয় ‘রিয়েল লাইফ মোগলি’। বছর খানেক আগে স্থানীয় এক ইউটিউব চ্যানেল ‘আফ্রিম্যাক্স’-এর সৌজন্যে প্রকাশ্যে এসেছিল রওয়ান্ডার যুবক জাঞ্জিমান এলি-র এমনই এক আশ্চর্যকর গল্প। এবার তার দেখা মিলল সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে।

এখন তার পরনে সাদা জামার ওপর ঝকঝকে কালো স্যুট। বদল এসেছে আচরণেও। নিজের পরিবারের থেকে দূরে সরে গিয়ে এতগুলো বছর যে অরণ্যযাপন করেছে, এখন রোজ সেই জাঞ্জিমানই হাজির হচ্ছে স্থানীয় স্কুলে। হয়ে উঠেছে সম্প্রদায়-মুখো। 

তবে জাঞ্জিমানের এই জার্নিটা খুব একটা মসৃণ ছিল না শুরু থেকেই। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিকভাবে বড়ো হয়ে ওঠার সুযোগও পায়নি সে। ১৯৯৯ সালে আফ্রিকার রওয়ান্ডার এক পরিবারে জন্ম জাঞ্জিমানের। হিসেব মতো জাঞ্জিমানই তার মায়ের ষষ্ঠ সন্তান। কিন্তু জন্মের সময়েই মারা গিয়েছিল তার অগ্রজরা। এলি সেই বাধা অতিক্রম করে গেলেও, প্রতিবন্ধকতা পিছু ছাড়েনি। জন্মগতভাবেই শুনতে ও কথা বলতে পারত না সে। সেইসঙ্গে তার মাথার আয়তনও ছিল শরীরের থেকে বেশ খানিকটা ছোটো। আদতে জাঞ্জিমান আক্রান্ত ছিল এক বিরল রোগে। চিকিৎসার পরিভাষায় যার নাম ‘মাইক্রোসেফালি’।

জাঞ্জিমানের বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন, তা ভালোই বুঝেছিল তার পরিবার। কিন্তু আফ্রিকার এই প্রান্তিক দেশে সেই সুযোগ কই? অর্থের যোগানই বা কোথায়? ফলত, ‘অস্বাভাবিকতা’-ই হয়ে ওঠে তার চিরকালীন সঙ্গী। সেইসঙ্গে বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পরিপার্শ্ব এবং ‘সভ্য’ সমাজের হেনস্থা এবং নিগ্রহের পরিমাণ। এই অত্যাচারের থেকে মুক্তি পেতেই কি অরণ্যযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলেছিল সে? জানা নেই সেই উত্তর।

গত বছর স্থানীয় ইউটিউব চ্যানেলে জাঞ্জিমানের এই গল্প উঠে আসার পরেই সাড়া পড়ে যায় গোটা বিশ্বজুড়ে। সংশ্লিষ্ট ইউটিউব চ্যানেলটিই নিজ উদ্যোগে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেছিল জাঞ্জিমানকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। হ্যাঁ, কথা রেখেছে তারা। রওয়ান্ডা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিল অনুদান। আর সেই অনুদানের সৌজন্যেই এবার অরণ্যযাপন ছেড়ে সম্প্রদায়মুখো হয়েছে ‘রিয়েল লাইফ মোগলি’।

বর্তমানে রওয়ান্ডার বিশেষভাবে সক্ষমদের একটি স্কুলেই পঠনপাঠন চালাচ্ছে জাঞ্জিমান। প্রাথমিকভাবে এই জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে না পারলেও, এখন তার বেশ সখ্যই গড়ে উঠেছে বাকিদের সঙ্গে। যেটুকু জড়তা আছে, তা আগামীদিনে কেটে যাবে বলেই আশাবাদী তার পরিবার। 

জাঞ্জিমান নতুন জীবন পেল ঠিকই। কিন্তু এই পৃথিবীতে সত্যিই কি সে একা? বিশ্বজুড়ে রোজ হাজার হাজার জাঞ্জিমান লড়াই করে যাচ্ছে মানসিক কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে। শিকার হচ্ছে হেনস্থার, সমাজের হিংস্রতার, অমানবিকতার। তাদেরও কি এমন সুন্দর ভবিষ্যৎ আমরা উপহার দিতে পারি না, আরও একটু সংযত হয়ে?

Powered by Froala Editor