কর্ভাস। ল্যাটিন ভাষায় এই নামেই পরিচিত কাক। তবে 'কর্ভাস' নামের আরও একটি চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত বাঙালি পাঠকমহল। প্রজাতিতে সে-ও কাক। কথা হচ্ছে, সত্যজিৎ রায়ের লেখা শঙ্কু সিরিজের গল্প 'কর্ভাস' নিয়ে। অর্নিথন যন্ত্রের মাধ্যমেই সামান্য এক কাকের মধ্যে মানবসুলভ বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন গিরিডি-বাসী বাঙালি গবেষক। তার কাণ্ড-কারখানা রীতিমতো অবাক করে দিয়েছিল পক্ষীবিজ্ঞানীদেরও। কিন্তু বাস্তবে কি এমনটা সম্ভব?
না, অর্নিথন বলে কোনো যন্ত্রের অস্তিত্ব নেই বাস্তবে। তবে আজ থেকে আশি বছর আগে, মানুষের প্রশিক্ষণ পেয়েই রীতিমতো তারকা হয়ে উঠেছিল একটি কাক। তার কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ তো বটেই, রীতিমতো অবাক করেছিল কিংবদন্তি অভিনেতা জিমি স্টিউয়ার্টকে। কে এই তারকা-পক্ষী?
জিমি দ্য র্যাভেন (Jimmy The Raven)। চলচ্চিত্রের প্রতি যাঁদের আগ্রহ রয়েছে, চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশের দশকে তৈরি সাদা-কালো হলিউডি চলচ্চিত্র খুঁটিয়ে দেখেছেন যাঁরা, তাঁরা অনেকেই নিজের অজান্তেই সাক্ষাৎ পেয়েছেন জিমি নামর এই দাঁড়কাকটির। সবমিলিয়ে প্রায় ছ-শোরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করার কৃতিত্ব রয়েছে জিমির। বিশেষত পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক কাপ্রার প্রায় সমস্ত সিনেমাতেই কোনো-না-কোনো চরিত্রে অভিনয় করেছে জিমি। কিন্তু কার প্রশিক্ষণে তারকা হয়ে উঠেছিল সে?
১৯৩৪ সাল। মোজাভি মরুভূমিতে একটি চলচ্চিত্রের কাজে গিয়েই, জিমিকে খুঁজে পান হলিউডের পশু-প্রশিক্ষক কার্ল টুইফোর্ড। একটি পরিত্যক্ত বাসায় অনাহারেই ছটফট করছিল বায়স-শাবকটি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও, তার বাবা-মার দেখা না-পেয়ে ছোট্ট কাকটিকে দত্তক নেন টুইফোর্ড। নাম রাখেন জিমি। টুইফোর্ডের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে ওঠে জিমি।
ঈশপ-বর্ণিত কাকের জল খাওয়ার গল্পের সঙ্গে সকলেই পরিচিত আমরা। ফলে, কাক যে বুদ্ধিমান, আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। তবে টুইফোর্ডের প্রশিক্ষণ পেয়ে আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠেছিল জিমির বুদ্ধি। টাইপরাইটারে টাইপ করা থেকে শুরু করে পিগি ব্যাংক বা ভাঁড়ে কয়েন ফেলা, টেলিফোনে নম্বর ডায়াল করা, খাম খুলে চিঠি বের করে আনা, সিগারেট ধরানো-সহ একাধিক মানবসুলভ কাজ করতে পারত জিমি। এমনকি বিশেষভাবে তৈরি মিনিয়েচার মোটরসাইকেল চালাতে পারত সে। পাশাপাশি তার ভাঁড়ারে ছিল কয়েকশো ইংরেজি শব্দ। না, উচ্চারণ করতে না পারলেও, এইসব শব্দ শুনে দিব্যি কাজ করতে পারত জিমি। কোনো চলচ্চিত্রের জন্য নতুন কোনো শব্দ শিখতে সময় নিত মাত্র এক সপ্তাহ। টুইফোর্ডের কথায়, যে-কোনো কাজের ক্ষেত্রে একজন ৮ বছর বয়সি মানবশিশুকেও হার মানাতে সক্ষম সে।
ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রার হাত ধরেই চলচ্চিত্রের জগতে প্রথম আত্মপ্রকাশ জিমির। 'ইউ কান্ট টেক ইট উইথ ইউ' ছবিতে সে অভিনয় করেছিল মার্টিন ভ্যান্ডারহফের উদ্ভট পোষ্যের চরিত্রে। জিমি অভিনয় পরিচালক এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, 'ইট'স আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ', 'আর্সেনিক', 'ওল্ড লেস'-সহ কাপ্রার প্রায় সব ছবিতেই কম-বেশি দেখা গেছে দাঁড়কাকটিকে। তাছাড়াও 'দ্য ব্রাইড কাম সিওডি', 'দ্য উইজার্ড অফ ওজ', 'মুন ওভার মায়ামি', 'সন অফ ড্রাকুলা', 'দ্য এনচান্টেড ফরেস্ট'-এর মতো জনপ্রিয় হলিউড ছবিতেও দেখা গিয়েছিল জিমিকে।
সে-যুগে জিমি হলিউডে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, মেট্রো-গোল্ডেন-মেয়র স্টুডিও ১০ হাজার মার্কিন ডলারের বীমা করেছিল জিমির জন্য। জিমির দেখাশোনার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল দুজন পরিচারিকার। কোনো সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সপ্তাহ-পিছু তার বেতন ছিল ৫০০ মার্কিন ডলার। তাছাড়াও তার প্রশিক্ষক পেতেন ২০০ মার্কিন ডলার। তৎকালীন বাজারে যার মূল্য কম নয় মোটেই। অভিনেতা জিমি স্টিউয়ার্টের কথায়, অভিনয়ের ক্ষেত্রে তাঁর থেকেও দড় ছিল তাঁর নেমসেক এই পক্ষীটি। শুটিংয়ের সেটে দ্বিতীয়বারের জন্য কোনো শট রিটেক নেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না তার।
বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে চলচ্চিত্র জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য 'রেড ক্রস' স্বর্ণপদকে সম্মানিত করা হয় জিমিকে। তাছাড়াও সেরা প্রাণী অভিনেতা হিসেবে আরও বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছিল জিমি। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পাওয়া 'থ্রি রিং সার্কাস' ছবিতে শেষবারের জন্য দেখা গিয়েছিল জিমিকে। এই সিনেমার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন জিমির মালিক, প্রশিক্ষক এবং আশ্রয়কর্তা টুইফোর্ড। ১৯৫৬ সালে মারা যান তিনি। আর জিমি? টুইফোর্ডের মৃত্যুর পর আর কোনো চলচ্চিত্রেই দেখা যায়নি জিমিকে। এমনকি সংবাদমাধ্যম থেকেও চিরতরে হারিয়ে যায় বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা-পক্ষীটি।
Powered by Froala Editor