ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন নীতিকে আটকাতে কিছু একটা করতেই হবে। রাজনৈতিক থেকে সামাজিক পরিসরে বাঙালির তখন এই একটাই চিন্তা। এমন সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন, রাখিবন্ধন করতে হবে। বাঙালির মধ্যে ঐক্যের সূত্র হবে সেটাই। তবে একটা অনুষ্ঠান করা তো আর মুখের কথা নয়। তার জন্য প্রস্তুতি চাই, তিথি স্থির হওয়া চাই। তবে তিথি স্থির হল নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে নয়, বরং ব্রিটিশ সরকার যেদিন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে শিলমোহর দেওয়ার কথা জানাল সেদিনই স্থির হল ‘রাখী বন্ধন উৎসব’।
পঞ্জিকায় উল্লিখিত অজস্র তিথির মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন আজ, রাখি পূর্ণিমা। বছরে এই একটি দিন ভাইয়ের মঙ্গলকামনায় হাতে রাখি বেঁধে দেয় বোন। কিন্তু এমনও হতে পারে, একটি বছরে পঞ্জিকায় উল্লেখ থাকল দুটি রাখির দিন। তার মধ্যে একটি আবার পূর্ণিমাই নয়। হ্যাঁ, সেই দিনটা ১৬ অক্টোবর ১৯০৫। কথক ঠাকুর ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর চেষ্টায় সেবারের পঞ্জিকাতেও স্থান পেয়েছিল দিনটি। তবে তিনি বলেছিলেন, পঞ্জিকায় এই দিনটা থেকে যাবে। এখন অন্তত আর নেই। এমনকি কত বছর পর্যন্ত ১৬ অক্টোবর দিনটি বাঙালির রাখি বন্ধন উৎসব বলে পরিচিত ছিল, তারও কোনো সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে রাখির সঙ্গে সেই মৈত্রীর সম্পর্ক যেন আজও থেকে গিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধন উৎসব নিঃসন্দেহে সেই সময়ের একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম। তবে সেইসঙ্গে এক নতুন কাজও বটে। গাড়ি হাঁকিয়ে সাহেবি কেতায় মিটিং করা আর নয়। বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে গেলে ধরে রাখতে হবে বাংলার সংস্কৃতিকে। ছুঁইয়ে দেখতে হবে বাংলার রূপ-রস-গন্ধকে। তাই ঠিক হল সকাল সকাল জগন্নাথ ঘাটে স্নান সেরে সকলে সকলের হাতে রাখি পরিয়ে দেবে। আর পুরো রাস্তাটাই যাওয়া হবে পায়ে হেঁটে। রবীন্দ্রনাথ একাই নন, ঠাকুরবাড়ির যেসব তরুণের তখন গাড়ি ছাড়া মাটিতে পা পড়ত না তাঁরাও চললেন পায়ে হেঁটে। তার সঙ্গে সঙ্গে আবার চলল চাকররাও। চাকরে মনিবে এক ঘাটে স্নান! শুনে অনেকেই আঁতকে উঠেছিলেন। আবার অনেকেই বুঝেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার একটা কাল্পনিক বিভাজন তৈরি করে বাংলা ভাগ করতে চাইলেও রবীন্দ্রনাথ একেবারে বিভেদের মূলে আঘাত করেছেন।
গঙ্গাস্নানের পর প্রকাশিত হল সেদিনের ইশতেহার ‘বঙ্গচ্ছেদে রাখীবন্ধন’। তাতে সাক্ষর করলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রমেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ। সেইসঙ্গে স্থির হল, বাঙালির ঐক্যের কথা স্মরণে রেখে প্রতি বছর এই দিনটি রাখি বন্ধন উৎসব হিসাবে পালিত হবে।
এরপর শুরু হল শোভাযাত্রা। রবীন্দ্রনাথের সেই অমর বাণী ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ যেন প্রাণ পেল দীনেন্দ্রনাথের গলায়। এর মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পথের ধারে দেখা গেল একদল ঘোড়াকে দলাই-মলাই করছেন কয়েকজন সহিস। ধর্মে তাঁরা প্রত্যেকেই মুসলমান। অথচ সেসব কিছুই না ভেবে রবি ঠাকুর সোজা চলে গেলেন তাঁদের কাছে। সঙ্গে যোগ দিলেন বাকিরাও। সহিসদের হাতে রাখি পরিয়ে দেওয়া হল প্রথমেই। এরপর প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই তাঁদের কোলে তুলে নিলেন সবাই। জগন্নাথ ঘাট থেকে শোভাযাত্রা ধরে যে অপূর্ণতাটুকু থেকে গিয়েছিল, সেটা যেন একটি মূহূর্তেই ঘুচে গেল।
এরপর হয়তো সবাই ঠাকুরবাড়ির দিকেই ফিরে যেতেন। কিন্তু বাধ সাধলেন রবীন্দ্রনাথ। ঠিক করলেন চিৎপুরের বড় মসজিদে ঢুকে রাখি পড়িয়ে দেবেন প্রত্যেকের হাতে। এমন একটা পরিকল্পনা বোধহয় রবীন্দ্রনাথ বলেই নিতে পেরেছিলেন। মসজিদে ঢুকে রাখি পরাতে গেলে একটা রক্তারক্তি বেঁধে যাবে নিশ্চই। কিন্তু সেদিন কী হয়েছিল? অবনীন্দ্রনাথের জবানিতে, তিনি নিজে ভয় পেয়ে আগেই সরে পড়েছিলেন। কিন্তু বাকিরা সেদিন যথারীতি ঢুকে গিয়েছিল মসজিদের ভিতর। তারপর সামনে মৌলবি এবং অন্যান্য যাঁদের যাঁদের পেলেন তাঁদের প্রত্যেকের হাতে পরিয়ে দিলেন রাখি। না, রক্তারক্তি কিছুই হয়নি। প্রত্যেকেই তখন মেতে উঠেছিলেন মৈত্রীর মেজাজে। আর সেই দিনটাই তো আগামী সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নতুন রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধনের সেই আহ্বান আজও সমানে বহমান। আর দেশভাগের এত বছর পরেও সেই রবীন্দ্রনাথের গানই মিলিয়ে রেখেছে দুপারের মানুষকে।
তথ্যসূত্রঃ ঘরোয়া, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Powered by Froala Editor