ব্যথানাশক হিসাবে ‘তেজস্ক্রিয়’ ওষুধ সেবন, কী পরিণতি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?

১৯২৭ সালের নভেম্বর মাস। গলফ প্রতিযোগিতা জিতে বাড়ি ফিরছিলেন আমেরিকান ক্রীড়াবিদ, উদ্যোগপতি ও অন্যতম ব্যবসায়ী ইবেন বায়ার্স (Eben Byers)। ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরা। বিনোদনের জন্য সবকিছুই মজুত সেখানে। রয়েছে বিলাসবহুল শয্যাও। তবে এতকিছুর মধ্যেও বিপত্তি ঘটে গেল। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দ্বিতল বিছানার ওপর থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে গেলেন ইবেন। একে শীতকাল, তার ওপর ফুট দশেক উপর থেকে কাঠের মেঝেতে পড়ে যাওয়া— গুরুতর চোটের শিকার হয়েছিলেন ইবেন, তা বলার অপেক্ষা থাকে না। তবে এই চোটই যে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেবে তাঁর গোটা জীবনকে, কে-ই বা জানত তখন?

হ্যাঁ, এই সামান্য ঘটনাই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনকুবেরকে। না, চোটের জন্য প্রয়াত হননি তিনি। বরং, তাঁর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এই আঘাতের চিকিৎসা। একটি বিশেষ ওষুধ। ফিরে যাওয়া যাক সেই গল্পে। 

বাড়ি ফিরেই পারিবারিক চিকিৎসক সিসি ময়ারের কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলেন ইবেন। তাঁর বাঁ হাত তখন প্রায় অচল। ফুলে ঢোল হয়ে রয়েছে হাতের কব্জি ও কনুই। নাড়ানোর জো নেই। বেশ খানিকক্ষণ পরীক্ষানিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানালেন, ব্যথা থাকলেও, ভাঙেনি হাতের হাড়। ফলে, আশঙ্কার কিছু নেই। তবে এই চোট সম্পূর্ণভাবে সেরে উঠতে সময় লাগবে বেশ। কিন্তু এই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দৈনন্দিনের কাজ করা কি সম্ভব? সেই সমাধানও দিলেন ডাঃ ময়ার। প্রেস্ক্রিপশনে লিখে দিলেন এক আশ্চর্য ওষুধের নাম। ‘র‍্যাডিথর’ (Radithor)। প্রতিদিন এক চামচ করে এই সিরাপ খেলেই নাকি ব্যথা কমে আসবে তাঁর। 

ময়ারের এই চিকিৎসায় যে খুব প্রসন্ন হয়েছিলেন ইবেন, এমনটা একেবারেই নয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই একটু একটু করে বদলাতে থাকে তাঁর ধারণা। বুঝতে পারেন, এক আশ্চর্য জাদুকরী প্রভাব রয়েছে ময়ারের দেওয়া ওষুধটিতে। একদিকে যেমন দ্রুত কমছিল হাতের যন্ত্রণা, তেমনই যেন এই ওষুধের প্রভাবে বাড়তি শারীরিক শক্তি পেতে শুরু করেন ইবেন। সে-কথা নিজের ডায়েরিতেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। পেশার ক্রীড়াবিদ হওয়ায় র‍্যাডিথরের এই আশ্চর্য প্রভাব রীতিমতো তাঁকে সাহায্য করত গলফের ময়দানে। ফলে, ব্যথা সেরে যাওয়ার পরও র‍্যাডিথর খাওয়া চালিয়ে যান ইবেন। চিকিৎসকের কোনোরকম পরামর্শ ছাড়াই। 

প্রথমের দিকে এক চামচের পরিবর্তে কয়েক চামচ করে এই ওষুধ খেতেন ইবেন। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার মাত্রা। একটা সময় র‍্যাডিথর সেবন প্রায় নেশা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কাছে। প্রতিদিন ৩ বোতল র‍্যাডিথর সেবন করতেন ইবেন। হিসেব অনুযায়ী, ১৯২৭-১৯৩০— এই চার বছরে সবমিলিয়ে প্রায় ১৪০০ বোতল র‍্যাডিথর পান করেছেন তিনি। 

হ্যাঁ, ইবেনের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে এই ওষুধটিই। ১৯৩০ সাল থেকেই আশ্চর্য সব সমস্যা শুরু হয় তাঁর শরীরে। খসে পড়তে শুরু করে হাত-পায়ের চামড়া। ভঙ্গুর হয়ে ওঠে শরীরের হাড়। এমনকি বাধ্য হয়ে ১৯৩১ সালে নিচের চোয়াল অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হয় তাঁকে। তবে সমস্যা মেটে সেখানেও। কিছুদিনের মধ্যেই উঠে যায় সমস্ত চুল। এমনকি মাথার চামড়া ও খুলি ক্ষয়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে দগদগে মস্তিষ্ক। শেষ অবধি ১৯৩২ সালের ৩১ মার্চ প্রয়াত হন ইবেন। 

অবশ্য মার্কিন ধনকুবেরের এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর পিছনে যে দায়ী র‍্যাডিথর, তা তখনও পর্যন্ত বুঝতে পারেননি কেউ-ই। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে সময় লেগে যায় কয়েক দশক। ১৯৬৫ সাল, ইবেনের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য, সমাধিক্ষেত্র থেকে তাঁর মৃতদেহ উত্তোলন করেন বিজ্ঞানীরা। আর তাঁর অবশিষ্টাংশের নমুনা বিশ্লেষণ করেই রীতিমতো চমকে ওঠেন গবেষকরা। প্রকাশ্যে আসে ইবেনের ভঙ্গুর হাড় এবং শরীরের চামড়া খসে পড়ার জন্য দায়ী তেজস্ক্রিয়তা।

তৎকালীন নথি বলছে, ইবেনের অবশিষ্টাংশের তেজস্ক্রিয়তার পরিমাপ ছিল ২ লক্ষ ২৫ হাজার বেকারেল। যেখানে স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া হয়, কোনো খাদ্যদ্রব্য ৪০০০ বেকারেল তেজস্ক্রিয়তার শিকার হলে, তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে মানুষের পক্ষে। ফলে এই পরীক্ষাই প্রমাণ করে দেয়, দীর্ঘদিন ধরে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শিকার হয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই তাঁর পুরনো ডায়েরি এবং অন্যান্য নথি ঘাঁটতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। সেখান থেকেই উঠে আসে ‘র‍্যাডিথর’-এর নাম। 

এবার এই আশ্চর্য ওষুধটির সম্পর্কেও বলে নেওয়া যাক কয়েকটি কথা। উনিশ শতকের শেষ লগ্নে রেডিয়াম আবিষ্কার করেন মাদাম ও পিয়ের কুরি। এর কয়েক বছর পর, ইলেকট্রন আবিষ্কর্তা জেজে থমসন কুয়োর জল পরীক্ষা করে জানান, বেশ কিছু কুয়োর জলে উপস্থিত থাকে রেডিয়াম। তবে তার মাত্রা খুবই কম। 

থমসনের এই আবিষ্কারের পরই, একদল গবেষকের ধারণা তৈরি হয়, রেডিয়ামের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আশ্চর্য রোগ নিরাময়কারী ক্ষমতা। ফলস্বরূপ ‘র‍্যাডিথর’-এর জন্ম। নেপথ্যে নিউ জার্সির ইস্ট অরেঞ্জে অবস্থিত ‘বেইলি রেডিয়াম ল্যাবরেটরিজ’। সংস্থার মালিক উইলিয়াম জে বেইলি ছিলেন হার্ভার্ডের কলেজছুট রসায়নবিদ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোনো নির্দিষ্ট ডিগ্রিও ছিল না তাঁর। তা সত্ত্বেও ব্যথানিরামক ওষুধটি বানিয়ে ফেলেন তিনি। উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয় রেডিয়াম, মেসোথেরিয়াম এবং পরিশ্রুত পানীয়। এই ওষুধ যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বহু চিকিৎসকই পাগলামি, ডায়েরিয়া, আঘাত পুরুষত্বহীনতার ওষুধ হিসাবে লিখে দিতেন র‍্যাডিথরের নাম। অবশ্য দীর্ঘমেয়াদে তা যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে মানবদেহে, তা প্রমাণিত হয় কয়েক দশক পর। ততদিনে অবশ্য বন্ধ হয়ে গেছে বেইলির সংস্থা।

আশ্চর্যের বিষয় হল, বেইলি ‘র‍্যাডিথর’-এর প্রচার করতেন ‘কিওর অফ দ্য লিভিং ডেড’ নামে। ঘটনাচক্রে এই ওষুধই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বহু মানুষের। হ্যাঁ, শুধু ইবেনই নন, তাঁর মতো বহু মানুষেরই নেশা হয়ে উঠেছিল র‍্যাডিথর-সেবন। এ-ধরনের প্রায় ৩০টি দেহ কবর খুঁড়ে বার করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। প্রতিটির ক্ষেত্রেই ক্যানসার ও মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব প্রত্যক্ষ করেন তাঁরা। পরবর্তীতে কবরে ফিরে না দিয়ে পুরু সীসার তৈরি বাক্সে সংরক্ষণ করা হয় এই মৃতদেহগুলি। আগামী ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তেজস্ক্রিয় থাকবে সেগুলি, এমনই অনুমান বিজ্ঞানীদের।

Powered by Froala Editor