১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট। চোখের নিমেষে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল দু-দুটি জাপানি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকি। নেপথ্যে এক আশ্চর্য বোমা। আজকের যুগে এসে আমরা সকলেই জানি ঘাতক পারমাণবিক অস্ত্রের এই অন্ধকার ইতিহাস। বারুদের বদলে তাতে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল দুটি আশ্চর্য মৌল— ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম। যা পারমাণবিক বিভাজন করে উৎপন্ন করে বিপুল পরিমাণ শক্তি। যা মুহূর্তে গলিয়ে ফেলতে পারে কংক্রিটকেও। তবে যদি বলা হয়, এই দুই তেজস্ক্রিয় মৌল বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান বহু মানুষ?
শুনেই চমকে উঠলেন নিশ্চয়ই? না, কোনো ধাঁধাঁ নয়। আক্ষরিক অর্থেই আজও বহু মানুষ জীবিত রয়েছে এই পৃথিবীতে, প্লুটোনিয়াম (Plutonium) বুকে নিয়েই দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন যাঁরা। কিন্তু কীভাবে?
ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যাক। পেস-মেকার (Pace-Maker)। এই যন্ত্রটির সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষের অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের প্রতিকার হিসাবেই ব্যবহার করা হয় এই বিশেষ যন্ত্রটি। ডায়াফ্রেম কিংবা হৃদযন্ত্রের ঠিক নিচেই স্থাপন করা হয় পেসমেকার। যা বাহ্যিকভাবে স্পন্দন তৈরি করে হৃদপিণ্ডের বাইরের স্তরে। যা হার্ট-মাসল বা হৃদপিণ্ডের পেশিকে নির্দিষ্ট ছন্দে সংকুচিত-প্রসারিত করতে সাহায্য করে।
তবে স্বয়ংক্রিয় এই যন্ত্র তো আর নিজে নিজেই চলতে পারে না, তার জন্য প্রয়োজন বৈদ্যুতিক শক্তির। প্রাথমিকভাবে পেস-মেকারে শক্তি সরবরাহ করত ব্যাটারি। অবশ্য তার ক্ষমতা ছিল সীমিত। প্রতি ২-৩ বছর ছাড়া ছাড়াই এই ব্যাটারি পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ত। তবে বাইরে থেকে সেই ব্যাটারি বদলানোর সুযোগ নেই কোনো। কাজেই বারবার অস্ত্রোপচারের সম্মুখীন হতে হত রোগীকে।
এই সমস্যার সমাধান হিসাবেই, ষাটের দশকে ব্যাটারির পরিবর্তে পেস-মেকারে পারমাণবিক ব্যাটারি ব্যবহার শুরু করেন মার্কিন গবেষকরা। এই ব্যাটারিতে মূলত জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হত ইউরেনিয়াম। পরবর্তীতে অর্থাৎ সত্তর দশকের গোড়ায় ইউরেনিয়ামের পরিবর্তে প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করা শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। যা খুলে দিয়েছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত।
স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসতে বাধ্য সকলের মনে। সামান্য তেজস্ক্রিয় মৌলের সংস্পর্শে আসলেই, তা প্রাণহানির কারণ হয়ে উঠতে পারে মানুষের জন্য! তবে দেহের মধ্যে প্লুটোনিয়াম নিয়ে কীভাবে ঘুরে বেড়াত মানুষ? খুলে বলা যাক ব্যাপারটা। পারমাণবিক বোমায় যে প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করা হয় তার ভরসংখ্যা ২৩৯ এবং ২৪০। প্লুটোনিয়ামের এই দুই আইসোটোপের থেকে তুলনামূলকভাবে কম তেজস্ক্রিয় ২৩৮ আইসোটোপটি। পেস-মেকারের জন্য মূলত এই আইসোটোপটিকেই বেছে নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। তবে তেজস্ক্রিয়তা একদম নেই ভেবে নিলেও ভুল হবে। প্লুটোনিয়াম থেকে নির্গত ক্ষতিকারক রশ্মি আটকাতে ব্যবহার করা হত লেড বা সিসার বেশ কয়েকটি স্তর। ফলে, মানবদেহে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারত না এই বিষ।
আশির দশকের শেষ, এমনকি নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকেও ব্যবহৃত হত এই প্লুটোনিয়াম পেস-মেকার। তারপর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় তার ব্যবহার। কারণ? প্রথমত এইধরনের পেস মেকারের ওজন ছিল সাধারণ পেস-মেকারের থেকে বেশ খানিকটা বেশি। দ্বিতীয়ত, রোগীর মৃত্যুর পর এই পেসমেকার বের করতে বাড়তি ঝক্কি পোহাতে হত। নইলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। তাছাড়া নব্বই-এর দশকে প্রযুক্তির দৌলতে মানুষের হাতে আসে প্রোমেথিয়ামের মতো হালকা মৌল এবং লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। যা কমপক্ষে ১৫-২০ বছর শক্তি সরবরাহ করতে পারে পেস-মেকারে। এই প্রযুক্তিই বর্তমানে চলছে গোটা বিশ্বজুড়ে। তবে প্লুটোনিয়াম পেস-মেকারের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলেও, এই যন্ত্র দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণে আজও বহু জীবিত মানুষ আজও ব্যবহার করছেন এই পেস-মেকার। বিশেষত আশির দশকের শেষ দিকে পেস-মেকার বসানো হয়েছিল যাঁদের শরীরে…
Powered by Froala Editor