ভালোবেসেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম রেখেছিলেন 'নলিনী।' সালটা ১৮৭৮। রবীন্দ্রনাথ তখন সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছেন। কলকাতার ৬নং দ্বারকানাথ লেনের মূল বাসভবনে তুমুল ব্যস্ততা। কিশোর রবিকে বিলেতে পাঠানোর জন্য সব প্রস্তুতিই প্রায় সারা, উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি যাবেন বিদেশে। এমন সময় দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এলেন বোম্বাই। উদ্দেশ্য, কিশোর রবির বিলেত যাবার জন্য একটি উপযুক্ত সঙ্গীর অন্বেষণ।
দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যস্ত মানুষ। বোম্বাই পৌঁছে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। অন্যদিকে কিশোর রবি সেই সময় প্রেমে পড়লেন উত্তাল আরব সাগরের। শেষ বিকেলের নিভে আসা সূর্য আর পাখিদের কলতান সমগ্র পরিবেশে এক অদ্ভুত মোহমায়া সৃষ্টি করেছে, আর সেই অদ্ভুত রূপময় প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে উত্তাল আরবসাগরের দিকে তার স্বপ্নালু চোখ নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিশোর রবি - এই দৃশ্যের সঙ্গে তখন পরিচিত দাদা সত্যেন্দ্রনাথ সহ আরও অনেকেই। সুগভীর অনন্ত নীল জলরাশি যেন অহরহ কাছে টানত তাঁকে। অবশ্য শুধুমাত্র রবির বিলেত যাত্রার জন্য উপযুক্ত সঙ্গী খোঁজাই নয়, সত্যেন্দ্রনাথের বোম্বাই আসার পেছনে আরও একটি কারণ ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন 'প্রার্থনা সমাজ'-এর সদস্য। প্রার্থনা সমাজের বেশিরভাগ অধিবেশন হত বোম্বাইয়ে। তেমনই কোনো এক অধিবেশনে যোগ দিতে ভাই রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে বোম্বাই পৌঁছন সত্যেন্দ্রনাথ।
মেয়েটির নাম আন্না তড়খড়। বাবা আত্মারাম ছিলেন একজন ডাক্তার। আন্না তড়খড় তখন সদ্য বিলেত থেকে পড়াশোনা করে ফিরেছেন। ঘটনাচক্রে আন্না তড়খড় এবং তাঁর বাবা আত্মারাম ছিলেন প্রার্থনা সমাজের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তি। সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আত্মারামের। একদিন আরবসাগরের তীরে বৈকালিক ভ্রমণে ব্যস্ত আত্মারাম এবং তরুণী আন্না। আরব সাগরের তীরের সেদিনের সেই বিকেলে আন্নার জীবন হয়তো তার অজান্তেই হঠাৎই ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করেছিল। বছর সতেরোর রবীন্দ্রনাথকে সেদিনই প্রথম দেখেছিলেন তিনি। সেদিনের সেই তরুণী আন্না তড়খড়ের দু-চোখের ভাষা বোধহয় পড়তে পেরেছিলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। অর্থাৎ প্রথম দর্শনেই প্রেম, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। এভাবেই শুরু হল তাদের প্রেমের পথচলা। দিনে দিনে প্রেমের গভীরতা বাড়তে লাগল দুই কিশোর-কিশোরীর। দাদা সত্যেন্দ্রনাথের বোধহয় কিশোর রবির প্রথম প্রেমকাহিনিতে নীরব সম্মতি ছিল সেকারণেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে বিলেতি আদব-কায়দা শেখার উদ্দেশ্যে পাঠালেন আন্না তড়খড়ের কাছে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আদৌ কতটা হয় সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকলেও, আন্নার সঙ্গে কিশোর রবির মন দেওয়া-নেওয়ার পথ যে অচিরেই আরও প্রশস্ত হয়ে ওঠে তা বলাই বাহুল্য।
না, কিশোর রবি যাঁকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন, পাননি। ইংরেজি এবং বিদেশি আদব-কায়দা শেখার অজুহাতে আন্না তড়খড় এবং রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেম বেশ কিছুদিন নিষ্কণ্টক পথে এগিয়ে চললেও এই প্রেমের খবর দেবেন্দ্রনাথের কানে পৌঁছতেই বাধ সাধলেন তিনি। যদিও রবির দাদা সত্যেন্দ্রনাথ এবং আত্মারাম নিজে এই সম্পর্ককে পরিণতি দিতে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু আন্না ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে বয়সে কিছুটা বড়ো এবং এই কারণটি তাদের প্রেমের পথে অন্তরায় হয়ে উঠল শেষ পর্যন্ত, একইসঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন কিশোর রবির শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে। আন্না তড়খড় ভালোবেসে একটি নাম চেয়েছিলেন তাঁর কিশোর প্রেমিকের থেকে, প্রথম প্রেমকে স্মরণীয় করে রাখতে। রবীন্দ্রনাথ দিয়েওছিলেন সেই নাম - 'নলিনী’। অন্যদিকে প্রথম প্রেমের স্মৃতিকে অমলিন রাখতে আন্না পরবর্তীকালে তাঁর ভাইপোর নাম রাখেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের শেষ মিক্সচার ও এক বিস্মৃতপ্রায় ওষুধের দোকানের গল্প
সেদিনের সেই কিশোর রবি প্রথম প্রেমকে যে শেষ বয়স পর্যন্ত ভোলেননি তার প্রমাণ মেলে পরবর্তীকালে তার সাহিত্য সাধনায়। ১৮৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন একটি নাটক। যার নাম ছিল - 'নলিনী’।' এমনকি কৃষ্ণ কৃপালিনী তাঁর 'ঠাকুর :- একটি জীবন' বইতেও রবীন্দ্রনাথ এবং অআন্না তড়খড়ের এই প্রেমকাহিনির উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বহু গানে কবিতাতেও তার প্রথম প্রেমিকার সন্ধান মেলে।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তা দর্শন নিয়ে যেমন প্রতিনিয়ত চর্চা হয়ে চলেছে তেমনি রবীন্দ্রনাথের অন্য-অন্য সম্পর্ক নিয়েও জলঘোলা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও কিশোর রবির এই প্রথম প্রেম আজও অনেকের কাছে অজানাই...
আরও পড়ুন
মসজিদে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ, রাখির বাঁধনে জড়িয়ে নিলেন মৌলবীদেরও
তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথের প্রেম, তানভীর আহমেদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন
রবীন্দ্র-জীবনে প্রেম, শাহ মতিন টিপু, রাইজিংবিডি.কম
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
যেতে হয়নি সুইডেনে, রবীন্দ্রনাথের জন্য কলকাতাতেই হাজির হয়েছিল নোবেল পদক