মানসিকভাবে ‘অপ্রস্তুত’ পেলেকে ’৫৮-র বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ মনোবিদের!

১৯৫৮-র বিশ্বকাপ। প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতে নজির গড়েছিল ব্রাজিল। জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল ছন্দময় স্বপ্নের ফুটবল। কিংবদন্তির জন্ম দিয়েছিলেন পেলে-গ্যারিঞ্চারা। কিন্তু এই দুই তারকাই যদি বাদ পড়ত ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে? হ্যাঁ, অবাক লাগলেও সত্যি। বিশ্বকাপ শুরুর আগে জাতীয় দল থেকে পেলে ও গ্যারিঞ্চাকে বাদ দেওয়ার কথা উঠেছিল ব্রাজিলে। 

শুরু থেকে বলা যাক এই গল্প। বিশ্বজয়ের পরে রাতারাতি নায়ক হয়ে উঠেছিলেন পেলে (Pele) কিংবা গ্যারিঞ্চা। গোটা বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সেলেকাও স্কোয়াড (Brazil)। তবে ফুটবল বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধারে-ভারে সেবার অন্যান্য দলের থেকে একাধিক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও, প্রবল মানসিক চাপের সম্মুখীন হতে হয়েছিল ব্রাজিল স্কোয়াডকে। 

১৯৫০ সালের মারাকানাজো অর্থাৎ মারাকানা ট্র্যাজেডির কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। গোটা টুর্নামেন্ট ভালো খেলেও শেষ মুহূর্তে উরুগুয়ের কাছে হেরে সেবার কাপ হাতছাড়া হয় ব্রাজিলের। ১৯৫৪ সালেও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয় ব্রাজিলকে। হাঙ্গেরির কাছে এই হার ভেঙে দিয়েছিল সেলেকাও ফুটবলারদের মনোবল। সেইসঙ্গে দেশবাসীর প্রবল আকাঙ্খা মেটানোর বাড়তি চাপ। 

এই মানসিক চাপ থেকে ফুটবলারদের মুক্ত করতেই বিশেষ মনোবিদ নিয়োগ করেছিল ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন। আর এই বিশেষ কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সাও পাওলোর মনোবিদ জাও কার্ভালেস। শুধু ফুটবলারদের মানসিক চাপ মুক্ত করাই নয়, জাতীয় দলের ফুটবলাররা বিশ্বকাপ খেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্বও ছিল তাঁর কাঁধে।

সেলেকাওদের দায়িত্ব নেওয়ার পর, দলের মানসিক অবস্থা বোঝার জন্য বিশেষ পরীক্ষার নেওয়ার ব্যবস্থা করেন জাও। জাতীয় দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কেই সেবার দিতে হয়েছিল ৫০ মিনিটের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে ব্রাজিল স্পোর্টস কনফেডারেশনে রিপোর্ট পেশ করেন তিনি। 

জাও কার্ভালেস 

 

সেই রিপোর্টেই নেগেটিভ স্কোর ছিল পেলে এবং গ্যারিঞ্চার। জাও-এর অভিমত ছিল পেলে বিশ্বকাপ খেলার জন্য অত্যন্ত তরুণ। ১৭ বছরের এক কিশোরের কাছে এ-পরিমাণ মানসিকচাপ নেওয়া প্রায় অসম্ভব। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘ফাইটিং স্পিরিট’-এর অভাব রয়েছে পেলের। অন্যদিকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’-এর তকমা পেয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা। ব্রাজিলের মতো মেধাবী দলের দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য নন তিনি, এমনটাই অভিমত ছিল জাও-এর।

সবমিলিয়ে জাও-এর পরামর্শ ছিল, ব্রাজিলের জাতীয় স্কোয়াড থেকে বাদ দিতে হবে এই দুই খেলোয়াড়কে। এমনকি তাঁর এই পরামর্শ নিয়ে রীতিমতো ভাবনা-চিন্তাও শুরু করেছিল ব্রাজিল স্পোর্টস কনফেডারেশন। তবে শেষ পর্যন্ত বাধ সাধে ব্রাজিল দলের কোচ ভিসেন্টে ফিওলা। কড়া ভাষায় ফিওলা জানিয়েছিলেন, জাও-এর রিপোর্ট সত্যি হোক আর না হোক, পেলে সুস্থ থাকলে বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে তিনি খেলবেনই। 

হ্যাঁ, হয়েওছিল তেমনটাই। গ্যারিঞ্চা এবং পেলে— দুই তারকাই সেবার খেলেছিলেন ব্রাজিলের হয়ে। জাও-এর ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যে প্রমাণ করেই ব্রাজিলকে এনে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপ। ১৯৬২ সালেও পেলে চোট পেয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলে, গ্যারিঞ্চা হাল ধরেন দলের। ব্রাজিলকে দ্বিতীয়বারের জন্য এনে দেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের শিরোপা। আর জাও? 

১৯৫৮-র বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলের এই মনোবিদের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে চর্চা চলেছিল দেশজুড়ে। তবে বিশ্বজয়ের পর বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে যান তিনি। আসলে জাও নিঃসন্দেহে ভালো মনোবিদ হলেও, ব্যক্তিগতভাবে ফুটবলের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ ছিল না তাঁর। কাজেই এ-ধরনের ভ্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি। অবশ্য ব্রাজিল স্পোর্টস কনফেডারেশনের মনোবিদ নিয়োগের সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে বিপ্লব আনে ক্রীড়াজগতে। ১৯৭০-র দশকের শেষ দিকে এসি মিলান আনুষ্ঠানিকভাবে মনোবিদ নিয়োগ করে দলের জন্য। তারপর ধীরে ধীরে তা ট্রেন্ড হয়ে ওঠে ফুটবল দুনিয়ায়। বিশেষ করে আজকের দিনে ওয়েলনেস ট্রেনার যে-কোনো ফুটবলের দলেরই অন্যতম সম্পদ…

Powered by Froala Editor