চারিদিকে দাঁড়িয়ে আছে শত্রুসৈন্য। মিনিটে মিনিটে ছুটে আসছে বন্দুক, কামানের গোলা। একটা দুটো নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে। আর তার মধ্যেই একা দাঁড়িয়ে আছেন এক সৈনিক। খুবই সাধারণ দেখতে, হয়তো বিরাট পেশিবহুল চেহারা নেই তাঁর। কিন্তু সাহস কি কেবল পেশি দেখিয়েই হয়? প্রায় একার হাতে শত্রুপক্ষের বিরাট সেনাদলকে কাবু করলেন তিনি। বিপক্ষ ভাবল, একজন নয়; হাজার জন দক্ষ সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছে তারা। তাও একবার নয়, দুবার এমন কীর্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাটি দেখেছিল এমনই এক বীরের রূপকথা। দেখেছিল অ্যানিবাল অগাস্টো মিলহায়েসের অদম্য সাহস…
পর্তুগালের ছোট্ট একটি গ্রামে, ততোধিক ছোটো ও দরিদ্র এক কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন অ্যানিবাল মিলহায়েস। নানা রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ হাজির হন সেনাবাহিনীতে। পরিবার ভেবেছিল, আর কিছু হোক না হোক, মাথা গোঁজার আশ্রয় তো পেয়েছে। ছেলের যদি আয়ু থাকে, তাহলে সে বাঁচবে। একটু একটু করে অ্যানিবালও মানিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত জোর। করতে তো তাঁকে হবেই, টিকে যেতে হবে জীবনযুদ্ধে। কিন্তু কয়েক বছর পর যে আসল যুদ্ধ আসছে, সেটাই বা কেমন করে জানবেন! তাও যে সে যুদ্ধ নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ…
বেলজিয়ামের রণক্ষেত্র। পর্তুগিজ সৈন্যরা এখানেই হাজির হলেন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। হাজির হলেন অ্যানিবাল মিলহায়েসও। প্রথম দিকে সেরকম আঘাত আসেনি তাঁদের দিকে। অবস্থা বদলে গেল তখনই, যখন বিশাল জার্মান সৈন্যদল হাজির হল বেলজিয়ামে। ১৯১৮ সাল। বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষের মুখে। আর এখনই তো মরণকামড় দেবে শত্রুপক্ষ!
১৯১৮ সালের এপ্রিল মাস। বেলজিয়ামের মাটিতে শুরু হল ‘দ্য ব্যাটেল অফ লা লিস’ বা ‘অপারেশন জর্জেট’। অ্যানিবাল মিলহায়েস-সহ পর্তুগিজ ও স্কটিশ সেনারা দাঁড়িয়ে আছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। বিপক্ষে জার্মান সেনার বিশাল বাহিনী। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে গুলি বিনিময়। মারাও গেছেন অনেকে। নির্দেশ এল, পর্তুগিজ ও স্কটিশ সেনাদের ওখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে। নয়তো আজকেই সব শেষ করে দেবে জার্মানরা। কিন্তু সরবে কী করে? জার্মানদের বন্দুকের গর্জন তো থামেনি একটুও! এগিয়ে এলেন অ্যানিবাল মিলহায়েস। হাতে নিলেন নিজের লুইস গান (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একপ্রকার লাইট মেশিন গান)। ঠিক করলেন, তিনি একাই সামাল দেবেন জার্মানদের। যতক্ষণ তিনি কভার দেবেন, ততক্ষণে বাকিরা ভালোভাবে চলে যাবে। এরপরই শুরু করে দিলেন বন্দুক চালানো। মনে করুন, উল্টোদিকে কয়েকশো জার্মান সেনা; আর এদিকে প্রায় একা অ্যানিবাল। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে তাঁর দিকে। একটু ভুলচুক হওয়া মানে জীবনের ইতি।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের নিয়েই প্যারালিম্পিকের পরিকল্পনা, আয়োজনে এক চিকিৎসক!
আর সেখান থেকেই অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন অ্যানিবাল মিলহায়েস। সমস্ত দিকে গুলি চালাতে লাগলেন তিনি। বিপক্ষের বহু সৈন্য মারা তো গেলই, আর তারা এগোতেও সাহস পেল না। কিন্তু সমস্তকিছুরই তো একটা শেষ থাকে। একটা সময় লুইস গানের গুলি শেষ হল। আর জার্মানরাও গোল হয়ে ঘিরে ফেলল পর্তুগিজ কম্পাউন্ড। এবার? একেবারে চুপ করে বসে থাকলেন অ্যানিবাল। তিনি যদি মারা যান, তাহলে এই জায়গাটি শত্রুদের দখলে চলে আসবে। ওই অবস্থায় তিনটি দিন বসে রইলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত অন্য একটি স্কটিশ সেনার দল এসে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনানী ভালুক, ধরিয়ে দিয়েছিল গুপ্তচরকেও!
কয়েক মাস পর আবারও একই অবস্থা। অ্যানিবালদের সঙ্গে ছিল একটু বেলজিয়ান ইউনিট। তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে নিয়ে যেতে হবে; এদিকে উল্টোদিকে অপেক্ষমান জার্মান সেনা। এবারও এগিয়ে এলেন অ্যানিবাল মিলহায়েস। সঙ্গে সেই লুইস গান। একার হাতে ঠেকিয়ে রাখলেন জার্মান সেনাদের। একজন বেলজিয়ান সেনার গায়েও গুলির আঁচটুকু লাগেনি। আর এই পুরো ঘটনাটি দেখলেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই বীরের মর্যাদা পেলেন অ্যানিবাল মিলহায়েস। ফ্রান্স সরকারের পক্ষ থেকে লিজিয়ঁ ডি অনার এবং পর্তুগালের সর্বোচ্চ সম্মান ‘দ্য অর্ডার অফ দ্য টাওয়ার অ্যান্ড সোর্ড’ পেলেন তিনি। উল্লেখ্য, তিনিই একমাত্র সৈন্য যাকে পর্তুগালের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
অতিমারীর মধ্যেই বাড়ছে উদ্বাস্তু-সংখ্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ
Powered by Froala Editor